সুন্দরবনে শিকার অভিযান
নীরাজনা ঘোষ
অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভালো ভাবে লক্ষ্য করে এবং কলেজ ছুটির পর একই সঙ্গে বাড়ি ফেরে। দু'জনের শরীরচর্চা একই সঙ্গে। খেলা ক্রিকেট। দু'জনেই দুর্দান্ত।
কলেজে ওদের বন্ধু-বান্ধব সীমিত। যাদের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব কেবল। ওদের দু'জনেরই হবি' বলতে ভ্রমণ কাহিনী। আর সেটা যদি জঙ্গলের হয় তাে কথাই নেই। একজন একটা বই পেলে সে পড়ে নিয়ে অপরকে পড়াবে। এইভাবেই ওদের চলছে।
হঠাৎ অজয়ের খেয়াল হলাে, ওরা শিকারে যাবে। কি শিকার করবে? 'বাঘ'।
তাও আবার বন্দুক দিয়ে নয়। ওদের যে ব্যাট বল আছে, তাই দিয়েই বাঘকে পিটিয়ে মারবে।
দু'জনে মিটিং-এ বসলাে। কিভাবে যাবে, কোথায় যাবে। সব চেয়ে বড় কথা কিভাবে বাঘকে ওরা আক্রমণ করবে, কিভাবে প্রতিহত করবে। প্রচুর আলােচনা হলাে। ওরা সঙ্গে নেবে দু’জনের দুটো করে চারটে ব্যাট, দু ডজন ডিউস্ বল। ছ'টা উইকেট। যেকোন লোক হঠাৎ দেখলে ভাববে যে, এরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছে।
বড় অদ্ভুত রকমের শিকার অভিযান। এ তাে 'গিনিস বুক-এ ওঠার মতাে ব্যাপার। অজয়ের যুক্তি বা বক্তব্য যাই বলা যাক না কেন, সেটা হচ্ছে শিকার তায় আবার বাঘ'। এতাে একটা 'এ্যাডভেনচার।-এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চারের মতই
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী
হওয়া উচিত। তাতে যদি থ্রিল না রইল, তবে আর এ্যাডভেঞ্চার কিসের। আর রিস্ক। সে তাে থাকবেই। বন্দুক থাকলেও থাকতো। বরং বন্দুকে গুলি না বেড়ােতে পারে, কিন্তু হাতের ব্যাটের পিটুনী থেকে বাঘ নিস্তার পাবে না। আর এটা খুব কাছ থেকেই হবে। অতএব ঠিক মত যদি ব্যবহার করা যায় তাে বাঘ মশায় বুঝতে পারবে যে এতদিন বন্দুকের গুলির ভজন ছিল, এখন হচ্ছে ব্যাট বল, উইকেট।
সত্যিই জিনিষটা বেশ অদ্ভুত ধরণের। ওরা এবার আলােচনায় বসলাে। সঙ্গে কি কি নেবে, এদের কৌশল কি হবে? সবচেয়ে প্রথম এবং বড় হচ্ছে মনােবল। বাঘের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ। লােকে শুনলে বলবে যে, এদের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এদের রাঁচীর পাগলা
গারদে পাঠাতে হবে। যাই হােক, কথা যখন উঠেছে, দুজনেই একমত হয়েছে তখন যেতেই হবে। আর খুব সাবধানে। সবচেয়ে বড় কথা হবে বাইরের কাউকে জানানাে হবে না যে, এরা এইভাবে শিকারে যাবে। তাহলে সবদিক থেকেই বাধা আসবে। প্রশাসন
ভেবে নেবেই যে, এরা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।
অতএব সব চুপচাপ। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাদের বলা হবে যে, ওরা বাইরে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে। একথা সবাই বিশ্বাসও করবে। কারণ সঙ্গে ক্রিকেটের সব রকম সাজসরঞ্জাম রয়েছে।
সরঞ্জাম ঃ চারটে ব্যাট বেশ মজবুত হওয়া চাই। দু ডজন ডিউস বা ছ'টা উইকেট। তিনসেলের দুটো টর্চ। দুটো হেড টর্চ—যে টর্চগুলাে সাধারণতঃ কোলিয়ারীতে ব্যবহার করা হয়। চারটে করে আটটা হ্যাণ্ডস্ গ্লাব। চারটে প্যাড। দুটো তাবু খাটাবার সবকিছু জিনিষ। তীক্ষ্ণ শব্দের দুটো হুইস। যাত্রায় যুদ্ধের দৃশ্যের সময় যেমন বর্ম পড়ে, সে রকম বুক, পিঠ ও হাতের
বর্ম। বড় শক্ত জাল দুটো।
চারটে ক্রিকেট হেলমেট। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, ব্যাণ্ডেজ ইত্যাদি। এইরকমের আরও উদ্ভট উদ্ভট সব জিনিষ। এই বাঘ শিকার করতে যেতে হবে খুবই সাবধানে। কারণ বাঘ হচ্ছে খুবই বুদ্ধিমান জীব। তাকে বােকা বানিয়ে
বেকায়দায় ফেলে আক্রমণ করতে হবে। এবার কৌশল ঠিক করতে হবে কিভাবে বাঘ কে বােকা বানানাে যায়। প্রথমে কোথায় তাবু খাটানাে হবে। দুটো তাবু খাটানাে হবে। একটা নিজেদের জন্য আর একটা বাঘ বােকা বানাবার জন্য।
বাঘের জন্য যে তাবু খাটানাে হবে, সেই জায়গাটা হবে, বাঘ সাধারণতঃ যেখানে আসবেই, অর্থাৎ জল খেতে। সেই রকম জায়গা দেখে এমনভাবে তাবু খাটাতে হবে যাতে সহজেই বাঘের চোখে পড়ে। সেই তাবুর মধ্যে বাঘকে আটকে ফেলার জন্য ফাদ পাতা হবে, বেশ শক্ত
জাল দিয়ে।
আর নিজেদের তাবু খাটানাে হবে এমন জায়গায় যেখানে সহজে লােকের বা জন্তুদের নজরে পড়বে না। তাবুর চারপাশে গাছ-গাছালির ঝােপ থাকবে। তার মধ্যে নিজেদের শােবার, খাওয়ার সব জিনিষপত্র থাকবে। বাঘের তাবুর ঠিক পেছনে থাকা চাই একটা গাছের জঙ্গল। যে দিক দিয়ে বাঘ
সহজে বেরােতে পারবে না। সেই দিকেও একটা জাল টাঙ্গানাে থাকবে। যদি বাঘ তাঁবুর ভেতর না ঢুকে বাইরে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে বাইরের জালে সে আটকা পড়বে। তারপর তাকে এদের হাতে পড়তে হবেই।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 2
সেই তাবুর পেছনে গায়ে গায়ে একটা আলাে এমনভাবে রাখা হবে যাতে সহজেই তাবুটা বাঘের নজরে আসে। আর এরা দু'জনে দুধারে গাছের আড়ালে ব্যাট এবং বল, উইকেট নিয়ে দু'ভাগে অপেক্ষা করবে। ওই বলগুলােকে ব্যবহার করা হবে অনেকটা গুলির মতন করে। দূর থেকে বলটা এমন ভাবে ছোঁড়া হবে যাতে সেটা বাঘের গায়ে জোরে আঘাত করে এবং সেই আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যেন সে তাঁবুর দিকে আসে।
প্রয়ােজনে উইকেটটা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে সেটা তার মুখের মধ্যে সােজাসুজি ঢুকে যায়। আবার প্রয়ােজনে বাঘ যখন হাঁ করে এগােতে থাকবে, তখন সেই হাঁ লক্ষ্য করে তীব্র বেগে বলটা মুখের মধ্যে ছুঁড়তে হবে। আর এটাও খেয়াল রাখতে হবে বাঘ যখন লাফ দেবে ওই অল্প সময়ের মধ্যে বল ছুঁড়ে খুব তৎপরতার সঙ্গে পাশে সরে গিয়ে বাঘকে আক্রমণ করতে হবে, অনেকটা ক্যারাটের মত দ্রুতগতিতে, যাতে বাঘ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘায়েল করা যায়।
প্রথম পর্যায়ে এই আলােচনা হলে। এর জন্য যে দ্রুতগতি তৎপরতার প্রয়ােজন, সেটা দু বন্ধুতে মিলে রােজ সকাল বিকেল অনুশীলন করতে লাগলাে। ওদের এই রকম হঠাৎ একটা বিষয়ে অনুশীলন করতে দেখে ওদের বন্ধুরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় ওরা বলেএমনি প্র্যাকটিস্ করছি। বহুদিন করিনি তাে,
যাতে মরচে পড়ে না যায়। তাই একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। নিজেদের সাংঘাতিকভাবে তৈরী করছে। শরীরটাকে ইস্পাতের মত শক্ত করেছে। চোখের দৃষ্টি প্রখর করতে হয়েছে। ক্ষিপ্রতা দারুণভাবে বেড়েছে। এতে দু-জনেই খুব সন্তুষ্ট।
এইবার এরা দুজনে দু’জনকে ঠিক বাঘের আক্রমণ করা এবং তা থেকে
নিজেদের বাঁচার পদ্ধতি, ক্ষিপ্রতা, এই সমস্ত ঠিকমত আয়ত্তে আছে কিনা পরীক্ষা করে নিচ্ছে। প্রায় ঠিকই হয়েছে। এবার একটা ভাল দিন দেখে যাত্রা শুরু করতে হবে।
ওরা ঠিক করেছে সুন্দরবনের দিকে যাবে। ওদিকে অনেক ছােট ছােট খাড়ি
আছে। তার একটাতে ঢুকে নিজেদের সুবিধা মত জায়গা দেখে শুনে আস্তানা
ঠিক করবে। বেশ ভালভাবে নিজেদের জিনিষপত্র ঠিক আছে কি না, দেখেশুনে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাে। আবার নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছে, বার বার আলােচনা করার অর্থই হচ্ছে, আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছু সুবিধে
অসুবিধে ধরা পড়ে। সেগুলি আবার ঠিকঠাক করে নেওয়া যায়।
এবার ওদের যাত্রা হলাে শুরু। প্রথমে ক্যানিং। ক্যানিং থেকে একটা ছােট্ট
ভুটভটি নিল। একান্ত নিজেদের জন্য। ভোটাভোটির চারজন লোক। তার মধ্যে নীরু মণ্ডল বলে একজনকে পাওয়া গেল। তার সঙ্গে কথা বলে এটুকু বােঝা গেল যে, নীরুর সুন্দরবনের এইসব খাড়ির সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। নীরু মাঝ বয়সী। শক্ত সামর্থ চেহারা। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করা গেল যে, নীরু মণ্ডল জাতে মুসলমান হলেও হিন্দু দেবদেবীদের খুব মানে, আর কথায় কথায় হাত তুলে বনদেবীকে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করছে। অজয় বিজয়ের নীরুকে খুব ভাল লাগলাে। ওকে নিজেদের একজন করে
নিল। ওকে বললাে যে, ওরা খুব কাছ থেকে বাঘকে দেখতে চায়। আর যদি
সেরকম অবস্থার মুখােমুখি হতে হয় তাে তখন নিজেদের বাঁচাবার জন্য যা করার সে তাে করতে হবেই। নীরু বলছে দেখুন বাবু'। এই বাবু' কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অজয় বললে দেখা নীরুদা, তুমি আমাদের বাবু বলে ডাকবে না তবে কি বলবােনীরুর প্রশ্ন। কিছুক্ষণ ভেবে বলল বেশ, তােমরা যখন আমায় দাদা
বলে ডাকছে আমিও তােমাদের দাদা বলে ডাকবাে। তােমায় অজয় না বলে আজুদাদা আর তােমায় বিজয় না বলে বিজুদাদা বলবাে। এই কথাগুলাে বলতে বলতে নীরু কেঁদে ফেললাে। চোখ মুছে বলল—দাদা এভাবে কেউ কিন্তু আপনাদের মত 'দাদা বলে আমায় কাছে টেনে নেয়নি।
বিজয় বাধা দিয়ে বলল—আবার আপনি কেন? বেশ তাে হচ্ছে।
নীরু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেআর হবে না দাদা। ভুটুভটি চলছে। আর নীরুর সঙ্গে সুন্দরবনে বাঘেদের সম্বন্ধে বহু কথা শুনছে।
এও শুনলাে যে, এখানে চোরাশিকারীরা এসে বাঘের অন্যায়ভাবে মেরে তাদের চামড়া বাইরে বিক্রী করছে বেশী দামে। শুধু শুধু মারার কোন মানে হয়। তারাও তাে ভগবানের জীব। তারা নিজেরা চরে বেড়াচ্ছে, নিজেদের মত। যদি তােমাদের কারুর কোন ক্ষতি করে তাহলে না হয় কথা।
সে তােমার কোন ক্ষতি করলাে না। তােমার খেয়াল খুশী মেটাবার জন্য একটা নিরীহ জন্তুর প্রাণ নিচ্ছ। এটা কি ঠিক দাদা, তােমরা তাে লেখাপড়া শিখেছাে, আমার চেয়ে অনেক বেশী। নীরুর কথাগুলাে শুনে অজয় বিজয় চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। খুবই সত্যি
কথা। ওদের বাঘ শিকার করা এক রকমের নৃশংসতা। বাঘটা জল খেতে বা বেড়াতে এসেছে। আর ওরা তাকে নিজেদের বুদ্ধি, শক্তি দিয়ে পিটিয়ে মারবে।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 3
তবু বিজয় বললে আচ্ছা নীরুদা, তুমি বাঘকে কি বলে 'নিরীহ বললে। নীরু ঠিক বলেছেন, নিরীহ আমি এই জন্যে বলছি যে, বাঘ কিন্তু তার প্রয়ােজন না হলে শুধু শুধু কারুর ক্ষতি করবে না। শুধু বাঘ কেন, কোন জন্তুই শুধু শুধু অন্য কারুর ক্ষতি করে না, তা যদি করতাে, তাহলে বনে আর জন্তু বলে কিছু থাকতাে না, যার ক্ষমতা বেশী সেই রাজত্ব করতাে।
আর তুমি যদি বলাে যে, বাঘ তাে হরিণ বা ওই ধরণের আরও নিরীহ জন্তুদের মেরে খাচ্ছে। সেটাও ঠিক। ওটা জানবে ভগবানের বিধান। তার প্রাণ ধারণের জন্য তাকে করতে হচ্ছে। আবার দেখাে, হরিণও লতাপাতা খাচ্ছে। খেয়ে জীবন ধারণ করছে। লতাপাতাও তাে ভগবানের দান। এগুলাে একের জন্যে আর একজনের সৃষ্টি। = অজয়—আমার মনে হয়, ওর পড়াশুনা আছে। তার মানে এই নয় যে,
নীরু কথাবার্তা, যুক্তি সব শুনে অজয় বিজয়ের চমক লেগে যায়। নীরু নীচে থেকে আসছে তাদের চা জলখাবার নিয়ে এই বলে চলে গেল। বিজয় বললে, দেখ অজয়? নীরুদাকে আমরা যতটা সাধারণ মনে করি, ঠিক ততটা নয় কিন্তু।
ইউনিভারসিটি ষ্ট্যাম্প। বিজয়—ইউনিভার্সিটি ষ্ট্যাম্প তাে রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না। তবে
অজয়-না, আমি বলছি, নীরুদার বাইরের জ্ঞান বেশ ভালই। অনেকের চেয়ে যথেষ্ট বেশীই বলতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করবাে, ও কতদূর পড়াশুনাে করেছে। বিজয়সে তাে হলাে। কিন্তু নীরুদার কথা শোনার পর কি আর ওইভাবে
পিটিয়ে শুধু শুধু বাঘ মারার কৃতিত্ব নেওয়া সম্ভব হবে। বিশেষতঃ নীরুদা সঙ্গে
থাকতে। অজয়ের, তাতাে বটেই। তবে দেখা তাে যাক, শেষ পর্যন্ত আমাদেরই এমন
একটা পরিস্থিতি তৈরী করতে হবে, যাতে নীরুদার ঐ মতটা যেন কাজে লাগে।
বিজয় কোন মতটা! অজয়—ঐ যে ক্ষতি না করেও তাকে হত্যা করা।
বিজয় এটা কিন্তু ঠিক অজয়, মানুষ ভগবানের শ্রেষ্ঠ জীব। সে তার খেয়াল
চরিতার্থ করার জন্য যা খুশী তাই করেছে এবং করবেও। এমন সময় নীরুদা তাদের জন্য চা, মুড়ি, নারকেল, তেল দিয়ে মেখে নিয়ে এলোরে।নওগাঁ দাদারা তােমাদের জলখাবার।
অজয় বিজয় মুড়ি, নারকেল দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাে। ওঃ নীরুদা, তুমি কি করছো। সাংঘাতিক! অনেকদিন পরে ..... আরে তােমার কই?
নীরু আমতা আমতা করে বললে আমি পরে খাবে। তোমরা তো আগে খাও। বিজয় না, আগে তােমারটা নিয়ে এসাে, তবে আমরা খাবাে। খেতে খেতে
গল্প করবো।
নীরু তবুও আমতা আমতা করতে, অজয় টেনে তুলে দিয়ে ওকে নিচে পাঠিয়ে দিল—তার খাবার আনার জন্য। সামান্য পরে নীরু শুধু মুড়ি নিয়ে এসে পাশে বসলাে। সেটা দেখে অজয় বললেনীরুদা নীচে থেকে দুটো কাঁচা লঙ্কা নিয়ে এসাে না গাে। তােমায় বলতে
ভুলে গেছি।
এই আনছি বলে নীরু নীচে গেলে অজয় নীরুর মুড়ির পাত্রটা নিয়ে নিজেদের সঙ্গে ভালাে করে মিশিয়ে ওর পাত্রে ওর ভাগটা রেখে দিল। নীরু লঙ্কা নিয়ে এলাে। বিজয় বলল দাঁড়াও, মনে হচ্ছে আমার কিট্স-এর মধ্যে চানাচুরের প্যাকেট আছে নিয়ে আসি।
বলে নিচে গিয়ে চানাচুর নিয়ে এসে তিনজনের খাবারের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে একসঙ্গে খেতে বসলাে। এদের ব্যবহার দেখে নীরু এতই বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে, খেতেই ভুলে গেছে। অজয়, বিজয় তাড়া লাগাতে খেতে বসলাে। তারপর নীরুদা বিজয় বললে তােমার কথা আমরা সত্যিই এতক্ষণ
আলােচনা করছিলুম যে, সত্যিই তাে বাঘদাদা যদি আমাদের কোন ক্ষতি না করে তাহলে আমরা শুধু শুধু কেন তাকে মারতে যাবাে! এইরকম গল্প চলছে, আর ভুটভটি ছুটছে। হঠাৎ পাশ একটা নৌকো থেকে
২।৩ জন নীরুকে দেখে চিৎকার করে উঠলো, নীরুদাদা, নীরুদাদা', এইরকম
অনেক ভাবে তাকে ডাকছে। নীরু ভটভটি থামালাে।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4
নৌকার লােকদের মধ্যে একজন বললেনীরুদাদা তােমার খোঁজেই আমরা বেড়িয়েছি। কেন রে কি হয়েছে, নীরুর প্রশ্ন
সতীশ জেঠুর নাতিটাকে একটা চিতায় মেরে
গেছে।
সে কি রে?' কি করে হলো এই অঘটন? ঐ বাচ্চাটা পাশের মাঠে খেলা করছিল-হঠাৎ রে রে শব্দ। কি?—না, সতীশ জেঠুর নাতিকে চিতাটা মেরেছে। বে নিয়ে যেতে পারেনি। খুব জখম
করেছে।
নীরু অজয় বিজয়কে বলে দাদারা, আমার আর তােমাদের সঙ্গে যাওয়া হ'লাে না। আমায় এখনই এদের সঙ্গে যেতে হবে। বিজয়—আমাদের গ্রাম কতদূর এখান থেকে? নীরুতা মাইল পাচেক হবে। অজয়নীরু সারেংকে ভট্ভটি ঘােরাতে বলাে। আমরাও যাবাে ওই গ্রামে।
আর তােমার নিরীহ চিতাকেও দেখবাে! নীরু আর কোন কথা না বলে সারেংকে ভটভটির গন্তব্যস্থল বলে নৌকোর
লােকদের বললে তারা আমাদের ভটভটিতে উঠে আয়। আমরা সবাই যাবাে। নৌকার লােকেরা তাড়াতাড়ি ভটভটিতে উঠে পড়লাে। ওরা যখন সেই গ্রামে পৌঁছলাে, দেখলাে যে, নদীর মাঠে অন্ততঃ কমপক্ষে পঞ্চাশজন বিভিন্ন বয়সের লােক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা নামতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলাে।
অজয় বললেন দাদা, আগে তােমাদের সতীশ জেঠুর বাড়ি চলাে। সেখানে পৌঁছে দেখে, বৃদ্ধ সতীশবাবু কিরকম চুপ চাপ বসে রয়েছে। ছেলেটাকে কাছাকাছি ডাক্তারখানায় নিয়ে গেছে।
গ্রামের লােকেদের জিজ্ঞেস করলাে যে, চিতাটা এখন কোথায় থাকতে পারে? ওরা পাশের একটা আধা জঙ্গল গােছের জায়গায় ওদের নিয়ে গেল। সবাইকে চলে যেতে বলে অজয় নীরু দাদাকে বললে, তুমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারাে। নীরুও বললেতােমাদের একলা ফেলে আমি যাবােও না।
অজয়, বিজয় সব জিনিষপত্র নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিকে চললাে। সঙ্গে নীরুও চলেছে। সামনে একটা জল রয়েছে। পাশে খানিকটা ফাকা মাঠ রয়েছে। সেখানেই সব জিনিষপত্র রেখে, প্রথমেই একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বিজয়কে অজয়
বললেতুই তৈরী হ'য়ে নে, আমি আশপাশটা একটু ঘুরে আসছি। বলে সামনে
এগিয়ে গেল। এদিকে বিজয় খুব তাড়তাড়ি সব জিনিষপত্র বার করে নিজেকে বর্ম, হেলমেট দিয়ে কভার করে ফেললাে, নীরু ও তাকে সাহায্য করেছে।
ওইখানেই একটা তাবু দু’জনে খুব তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে ফেললে। ভেতরে নীরুকে নিয়ে একটা জালও পেতে রাখলাে।
অজয় কিছুদুর গিয়ে পাশ থেকে কিরকম যেন একটা গন্ধ পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে
সতর্ক হয়ে গেল। চারপাশ বেশ ভাল করে দেখবার চেষ্টা করলাে। কিছুই বােঝা যাচ্ছে না। কারণ, এখানে বেশ অন্ধকার মতন। দিনের বেলা হলেও খুব একটা পরিষ্কার নয়।
ফিরে এলাে। এসে দেখে তাবু খাটানাে হয়ে গেছে। অজয় একবার ভাল করে দেখে নিয়ে নিজে এবার তৈরী হয়ে নিল।
অজয় বললেআমি গন্ধ পেয়েছি। চিতাটা খুব কাছেই আছে। এবার সে একটা বড় টর্চ বার করে পেছনের গাছটার গায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলাে যাতে ঐ জায়গাটা অন্ততঃ আলােকিত হয়ে থাকে। আর তাঁবুর সামনে-সামনের দরজাটা অল্প একটু খুলে রাখলাে।
বিজয় এবং নীরু বললে যে, চিতা কিন্তু খুব বুদ্ধিমান এবং ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন
হয়। অতএব চারদিকে নজর রাখতে হবে। অজয় নীরুকে একটা ব্যাট দিয়ে বলল—এটা হাতে রাখাে। খুবই জোরালাে
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4
এবং শক্ত করে। চিতা যেই লাফ মারবে, খুব তাড়াতাড়ি তুমি যেখামে আছাে তার থেকে দু-পা সরে গিয়ে সজোরে চিতার মুখে মারবে। কিভাবে মারবে সেটা অজয়
দেখিয়ে দিল। ওইটা যদি ঠিকভাবে চিতার চোয়ালে লাগে তাহলে ও এক ঘায়েই ঘায়েল হবে। অবশ্য তােমায় এতটা কষ্ট করতে হবে না, আমরা তাে এখানেই রয়েছি।
এই বলে অজয়, নীরুকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় রেখে দু'জনে তাঁবুর
দু'পাশে রইল। আর তাবুর ভেতরের জাল থেকে দু'ধারে দুটো দড়ি বার করে
রাখলাে ঠিক মত টানতে হলাে।
আর যদি টানার মত সুযােগও না আসে, তবুও চিতা তার ক্ষিপ্রতার জন্যই
আরাে জালে জড়িয়ে পড়বে। যত বেশী লাফালাফি করবে, তত বেশী জড়াবে। এইভাবে সব গুছিয়ে ফাঁদ পেতে রাখা হলো। নীতু বললেআজুদাদা, তােমাদের আর একটা জাল রয়েছে। ঐ জালটা
আমায় দাও, আমি তাে বহুবার মাছ ধরেছি। আমি এই ব্যাট চালানাের চেয়ে খুব
তাড়াতাড়ি জাল ফেলতে পারবাে। অজয় তাতে রাজী হয়ে ওকে একটা জাল দিয়ে দিল। তারপর নিজেদের বৃসার একটা জায়গা করলাে, ওই তাবু থেকে তার পাশেই সামান্য দূরে, যেখান থেকে তাবুটা বেশ দেখা যায়, সেরকম জায়গায় নিজেদের তাবুটা চটপট খাটিয়ে ফেললে। আর নীরু আবার পাশ থেকে গাছের ডাল পাতা ভেঙ্গে এনে বাবুর মাথায় চারপাশে এমনভাবে রাখলাে যে, দূর থেকে এটাকে আর তাবু বলে মনেই হবে
না। নীরুকে সাহায্য করলাে বিজয়। অজয় তাবুর ভেতর তাদের ফোল্ডিং টুল, টেবিল বার করে খাবার ব্যবস্থা করেছে। বিজয় আর নীরুকে ভেতরে ডেকে এনে বললে সব তাে ঠিক
হয়েছে এবারে পেটের ব্যবস্থা করা যাক আর আমি নিশ্চিন্ত যে, চিতা মহারাজ
কাছে পিঠেই আছেন। তার দর্শন পেতে আমাদের আর বেশী দেরী হবে না। কারণ,
ওই চিতাটা খানিকটা রক্তের স্বাদ পেয়েছে, আর ক্ষুধার্তও বটে। আমি তার গায়ের বা গন্ধ পেয়েছি। কিন্তু সবাইকে বেশ সতর্ক হয়ে থাকতে হবে সব সময়। তিনটে পেটে তিনজনের খাবার গুছিয়ে অজয় বললে দুটো পেটে তা দিতে হবে। শক্তি সঞ্চয় করতে হবে তাে, নাহলে চিতা-রাজের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে কি করে? নীরু ওদের সাজসরঞ্জাম দেখে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেছে। প্রথমটা ওদের
কথা মত কাজ করলেও পরে বুঝলাে যে, এটা যেন ছেলেখেলা হচ্ছে। আগুন নিয়ে খেলা। মৃত্যুর সঙ্গে ছেলে খেলা। শেষে খেতে খেতে বলছে আচ্ছা, আজু
ভাই, তােমরা যে এইভাবে সেজেছাে, এতাে যাত্রায় যখন-যুদ্ধ হয় তখন এইসব সাজ হয়।
অজয়ের দাদা, এটা তাে আমাদের একটা যুদ্ধই। আর আমরা বন্দুক
ব্যবহার করবাে না এই জন্যে যে, আমরা চাই বাঘের সঙ্গে সামনা-সামনি লড়তে।
অবশ্যই এখানে বুদ্ধিই হচ্ছে আমাদের বন্দুক। নীরু সবই তাে বুঝলাম, কিন্তু আমার মনে কি করম যেন বাধাে বাধাে ঠেকছে।
বিজয় নীরু দাদা, তােমায় আমি গােড়া থেকে বেশ লক্ষ্য করেছি এবং এখনও
করছি। তুমি একটা সত্যি কথা বলবে আমাদের!
নীরু সত্যি কথা! আমি তাে কোন মিথ্যা বলিনি তােমাদের। আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু Not a liar'। O a check You are not a liar, but সত্যি করে বলাে
তাে তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছেন।এখানে তুমি আমাদের ধন্দে রেখেছে। নীরু যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। "লজ্জার কি আছে, নীরু দাদা অজয় বললে বিদ্যা সকলের জন্য। এটা
কেউ নিজের বলে আঁকড়ে থাকতে পারে না। সেই পারে যে তাকে সত্যি সত্যি কাজে লাগাতে পারে। আর এটা তাে কারুর নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। শিক্ষা এমনই যে, যার আকাঙ্া আছে সে খুব বিরাট কিছু বিদেশ বিভূইতে গিয়ে শিক্ষা নেবে, তা না হতে পারে কিন্তু একটা নিম্নমান আছে যেখানে ইচ্ছা থাকলে সেটা করা যায়, অবশ্যই বেশ কষ্ট হয় তা জানি। তা তােমার নিম্নমানটা কি শুনি। নীরু আস্তে আস্তে মুখ তুলে বললে হায়ার সেকেন্ডারী পড়েছি কিন্তু পরী দেওয়া হয়নি।
অজয় কারণ? নীরু—কারণ যা, তা খুবই সাধারণ অন্যের কাছে কিন্তু অসাধারণ আমাদের মত গরীবদের কাছে।—“অভাব'।
বিজয়-খুবই কমন্ যা, তাই—অভাব। যেটা আমাদের সমাজে খুবই কম। এই অভাবের জন্য কত কি হয়ে যাচ্ছে। মা তার সন্তানকে বেচে দিচ্ছে, যুবতী মেয়ে তার ইজ্জত রাখতে পারছে না। বাবা বিষ খাইয়ে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে হত্যা করে কোথাও নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে আবার কোথাও গিয়ে পুলিশে সরাসরি ধরা দিয়েছে। এই অভাবই আমাদের খেয়েছে, খাচ্ছে এবং খাবেও। আর কতদিন যে আমরা এই অভাবের পোস্টার বুকে পিঠে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবাে তা জানি না। এক এক সময় খুবই বাজে লাগে।
নীরু খুবই সত্যি কথা বিজু দাদা। এই অভাবই আমাদেরমানে
মধ্যবিত্ত সমাজের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দিয়েছে।
এই
অজয়—বীরু দাদা, তুমি যদি কিছু মনে না করাে তাে তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে! সেখানে গিয়ে তুমি পড়াশুনা করবে।
নীরু ইচ্ছে তাই করে আজুদাদা, কিন্তু উপায় কোথায়। আলো কোথায়।
বিজয় অন্ধকারের পেছনেই সে আছে। অন্ধকারে জোর করে সরিয়ে দাও। দেখবে আলো ঠিক এসে পড়েছে। আর দেখাে, আলো হচ্ছে এমনই এক জিনিষ, যে, তাকে সাধ্যি সাধনা না করলে তার দর্শন পাওয়া যায় না। তাইতাে কবি
বলেছেন—“আলো, আলো আমার জীবন..” দেখাে, আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছে, আমরা গল্পে মেতে রয়েছে কি একটা যেন খস্ খস্ আওয়াজ হলাে না? সবাই সন্ত্রন্ত্র হয়ে উঠলাে। তাবু থেকে খুব সাবধানে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করেও কিছু দেখতে পেল না অজয়। ফিরে এসে বললেআমাদের খাওয়া যা হােক হয়েছে একরকম। এবার এদিকে একটু নজর দিতে হবে।
মহারাজের আবির্ভাব হয়তাে হতে পারে। বিজয় বললে হয়তো না-ও হতে পারে।
নীরু হঠাৎ প্রতিবাদ করে উঠলো"না বিজি দাদা, না। সতীশ জেঠুর অবস্থাটা তাে দেখেছাে নিজের চোখে। ছেলেটার কি অবস্থা তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। তবে এই চিতাকে আমি ছাড়বাে না।
অজয় তাকে পেলে তবে তাে। নীরুতাকে যে পেতেই হবে। এই চিতাটা ভয়ানক উপদ্রব শুরু করেছে। হরেন কাকার একটা বাছুর মেরেছে। বড়ে মিয়ার একটা ছাগল নিয়েছে। গ্রামের মধ্যে লােক নিশ্চিন্তে ঘােরাফেরা করতে পারছে না। তাকে পেতেই হবে। আমাকে, পেতেই হবে।
বিজয় সে তাে নিশ্চয়ই, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নীরু হ্যাঁ, সে তো বটেই। তবে শুভ লক্ষণ যে, আজু দাদা তার গায়ের গন্ধ যেমন পেয়েছে, সে-ও আমাদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে। অতএব সে আশেপাশেই কোথাও আছে। সুযােগ বুঝে সে ঠিকই তার কাজ হাসিল করার চেষ্টা করবে। - তবে, আমার মনে হয়, বাইরের ওই টর্চটা নিভিয়ে ছােট একটা আলাে যদি ওই
তাবুটার আশপাশে থাকে তবে অনেকটা জুতার মত লাগবে, তাবুটাও দেখা যাবে।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 5
অজয় উঠে গিয়ে ওই টর্চটার সামনে কয়েকটা গাছের পাতার আড়াল করে দিল তাতে আলোর তীব্রতা চলে গিয়ে একটা স্নিগ্ধতা নেমে এলাে।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে এলাে। সবাই সতর্ক হ'য়ে উঠলাে। যেকোন মুহুর্তে তাদের অ্যাকশানে নামতে হবে। আর এ যে সে অ্যাকশন নয়। চিতার সঙ্গে সম্মুখ সমরে। নীরু বললে-আজুদাদা, আমাদের কিন্তু ওপরের দিকে নজর রাখতে হবে
কারণ চিতা গাছের ওপরও লুকিয়ে থাকে, সময় বিশেষে।
“ঠিক বলেছেন, আমাদের ও দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। বলে বিজয় তাবুর বাইরে বেরিয়ে ওপর দিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে ওর কাছে যে পেন্সিল টর্চটা ছিল, সেটা জেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ ভালভাবে দেখছে। ও অবশ্য টর্চের মুখে ওর রুমালটা পাতলা করে চাপা দিয়ে রেখেছে, যাতে করে ওর তীব্রতাটা চিতার চোখে না পড়ে। হঠাৎ এক জায়গায় এসে ওর চোখ আটকে গেল। দেখা গেল কি একটা ঝুলছে। ভাল করে দেখেও বুঝতে পারছে না, ওটা কি ঝুলছে। আস্তে আস্তে অজয়কে ডাকলাে।
অজয় এবং নীরু দৌড়ে বিজয়ের কাছে দাঁড়াতে বিজয় ওই ঝােলা জিনিষটা
দেখিয়ে কি ওটা জানতে চাইলে নীরু বললে-দাদা, তােমার আশার জিনিষ এসে
গেছে। ওটা চিতাটার লেজ। ওটা সাপ নয়, তাহলে এতক্ষণে ওর মুখটা ওপর দিকে উঠে আসতাে। নীরুর কথা শুনে অজয় বললে, বিজয় অপারেশন এখনিই শুরু করতে হবে।
তুই আলােটা ঠিক এইভাবেই রাখবি। আমি যেই হুইসল বাজাবাে তুই অমনি আলাের মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিবি আর আমি বল চার্জ করবাে পরপর। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, তবে সবাই কিন্তু প্রস্তুত থাকবে। বলে অজয় ডিউজ বলের ব্যাগটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। ঐ আলােটা লক্ষ্য করে নিজে পজিশন নিয়ে খুব জোরে ওই বিদ্ঘুটে আওয়াজের হুইসল বাজালে!
সঙ্গে সঙ্গে রুমালের আড়াল সরে গিয়ে আলাে তীব্র হলাে এবং সেই সময়েই দেখা গেল একটা বল এসে ওপর দিয়ে চলে গেলফটাস্ করে একটা আওয়াজ হলাে আর গরু গর আওয়াজ করে কি একটা লাফিয়ে নীচে পড়লাে। এরা বড় আলােটা জ্বাললাে। কিছুই দেখা গেল না।
নীরু বললে, ভয় নেই বিজু দাদা। ওই চিতাটা চোট খেয়েছে, চোট খাওয়া চিতা খুব হিংস্র হয়ে যায়, আর সে তার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য আবার আসবে। আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
অজয় দৌড়ে ফিরে এলাে। বিজয় বলে—উইকেট ডাউন। চিতার গায়ে
লেগেছে, আওয়াজ পেয়েছি এবং সে লাফিয়ে পড়েছেও। তবে এখানে সে
আসবেই। অতএব আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অজয়তবে আমাদের এই তাবুর আশে-পাশেই থাকতে হবে। আর তাঁবুটা আরও লােভনীয় করে রাখতে হবে সেই চিতার আসার জন্যে।
নীরু-কিভাবে।
অজয় দেখবে না, বলে সে তার ব্যাটারী চালিত ছােট টেপ রেকর্ডারটা এনে চালাতেই একটা ছাগল বার বার ডাকতে শুরু করলাে। এই টেপটা ওই জালের মধ্যে থাকবে আর মাঝে মাঝে বাজবে আর সেই ডাকই হবে চিতা মহারাজের টোপ। তাকে এই তাবুর মধ্যে আসতে হবেই এবং এই জালে তাকে পড়তে হবেই। এবং
নীরু বাধা দিয়ে বলল এবং আমিই তাকে প্রথম পেটানাে শুরু করবাে। নীরুকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে। বিজয় ঠিক আছে, ঠিক আছে। নীরুদাদা এখন কিন্তু একদম উত্তেজিত হলে
চলবে না। আমাদের খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। একটু এধার ওধার হলেই সমূহ বিপদ।
অজয় বিজয়কে সমর্থন করে বলে—বীরু দাদা, তুমি, তাবুর এধারটায় থাকো, কারণ আমরা যেমন শরীরটাকে কিছুটা সুরক্ষিত করে রেখেছি, তােমার তাে তা নেই।
বিজয় বললে—কেন? নীরুদাদাকে একটা হেলমেট আর দুটো দস্তানা দিয়ে
দিলে, কিছুটা অন্ততঃ গার্ড হবে তাে। আর একটা বাঁশীও দিও। অজয় বলল হ্যা, হ্যা, ভুলেই গেছলাম যে, আমাদের এক্সট্রা একটা সেট রয়েছে। তবে বর্মটা নেই। নিল
নীরু বললো তাতে কি হয়েছে, এতেই হবে। নীরু নিজেকে হেলমেট আর দস্তানা দিয়ে তার হাতে ব্যাট রয়েছে।
সাজিয়ে
সবাই কান খাড়া করে রেখেছে। মাঝে মাঝে ছাগলের ডাকটা শােনা যাচ্ছে। নীরু হেসে ফেলে বলল সত্যি আজু দাদা তােমরা শহরের লােকেরা কত সহজেই একে অপরকে বােকা বানাতে পারাে।
নীরুর কথায় অজয়, বিজয় ওর দিকে তাকালে নীরু অপ্রস্তুত হয়ে বললে
দেখাে, আমি ঠিক সে ভাবে কথাটা বলিনি। তােমরা কিছু মনে করাে না। বিজয়-তুমি খুব সত্যি কথা বলেছাে নীরুদাদা, মানুষ যত বেশী শিক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের যত উন্নতি হচ্ছে, দেখাে মানুষ ততাে বেশী মানুষেরই শত্রু হয়ে
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 6
উঠছে। তা না হ'লে তােমরা দেখােরুগীর ওষুধ, "শিশুর খাদ্য, এ দুটোই হচ্ছে। মানুষের অতি প্রয়ােজনীয় জিনিষ। সেগুলোতেও এমনভাবে ভেজাল দিয়ে তার থেকে বিস্তর পয়সা লুটছে। আবার বড় বড় কোম্পানী বিভিন্ন রকমের 'সেন্ট অর্থাৎ গন্ধ আবিষ্কার করেছে। যেমন—কনি: ঘি, আম, লেবু ইত্যাদি বহু রকমের। আজেবাজে জিনিষের সঙ্গে সেই গন্ধ মিশিয়ে মানুষকে, মানুষই ঠকাচ্ছে। তােমরা ভাববে ও; কি সুন্দর দামী কফি খাচ্ছি, কি দামী ঘি খাচ্ছি, মনের সুখে খাচ্ছে
আর নিজেকে ক্ষয় করে ফেলেছো।
অজয় আর দেখাে, আজকাল, মানুষের সখের জিনিষ যেমন নিত্য নতুন বেড়ােচ্ছে, তেমনি নিত্য নতুন রােগেরও আবির্ভাব হচ্ছে। আর রােগের কোন বয়েস নেই। একটা তিন মাসের শিশু তারও হার্ট প্রবলেম। তার কতটুকুই বা হার্ট, তার আবার প্রবলেম।
বিজয়-হবে না-ই বা কেন? তার মা তাে ভেজাল খেয়েই বড় হয়েছে। তার
শরীরের ভেতরটা তাে ভেজালে ভরা। তারই শরীরের রক্ত, মজ্জা নিয়েই তাে
একটা শিশুর জন্ম। যার আসলটাই ভেজালে ভরা, পরেরটাকেও তার কিছুটা ভাগ
নিতে হবে তাে।
নীরুসাবধান! যে যার জায়গা নাও। মনে হচ্ছে মহারাজের আগমন হচ্ছে। দেখছেন না খুব খেয়াল করে শান্তা খস্ খস্ আওয়াজ শুনতে পাবে। সবাই খুব মনােযােগ দিয়ে সত্যিই একটা আওয়াজ পাচ্ছে। যেন কেউ অতি সন্তর্পণে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাে। সবাই ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত।
তারা সবাই এবার নিশ্চিত যে, চিতা তাদের খুবই কাছাকাছি এসে পড়েছে। কারণ তার গায়ে গন্ধ সবায়ের নাকে গেছে। কিন্তু কোনদিকে আছে কেউ-ই বলতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। অজয় ফিস্ ফিস্ করে সবাইকে বলে দিল—চিতাটা জালে পড়লেই জালের দড়ি টেনে তাবু গোটা খুলে দিতে হবে। তারপরে হরদম বাঁশী বাজিয়ে যাবে
সবাই। দেখতে দেখতে দেখা গেল চিতাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। ছাগলটাও থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝুপ করে চিতাটা লাফ দিল তাবুটার মধ্যে ঐ ছাগলের আওয়াজ লক্ষ্য করে। জালের দড়ি টানা হলাে। নীরুও তৎপরতার সঙ্গে তাবুর ঘোটা খুলে দিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনজনে মিলে একনাগারে বাঁশী বাজিয়ে চলেছে, বিকট আওয়াজ।' এই আওয়াজে এদেরই কানে তালা লেগে যাচ্ছে, তা ওই চিতার।
চিতাটা ক্রমশঃ লাফাচ্ছে ভেতরে। বাবুটা উঠছে, নামছে। আর তিনজনে মিলে ঐ তাবুর উপর ব্যাট দিয়ে পিঠে লাগছে। বাঘের কেবল লাফাচ্ছেই। তাবুর কাপড়টা মােটা তাই ব্যাটের আঘাত খুব একটা জোরে লাগছে না। তাই নীরু বললেতােমরা তৈরী হও, আমি তাবুটা তুলে ফেলছি। নীরু তাঁবুটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল চিতাটা জালে বেশ জড়িয়েছে।
অজয় তার কাছে গিয়ে তার ব্যাটটা দিয়ে খোঁচা দিলে চিতাটা তার একটা থাবা অজয়ের হাতে মারলাে অজয়কে সাবধান হওয়ার সুযােগ না দিয়েই। অজয়ের হাতে ক্ষত না হলেও চিতার থাবার জোর যা তাতে আঘাতটা বেশ জোরেই হয়েছে। এতে চিতাটা বুঝেছে যে, সে বন্দী হয়েছে তার ওপর ব্যাটের ঘা কয়েকটা পড়েছে। সবার ওপর সে বলের আঘাত পেয়েছে এবং সেটা বেশ জোরেই।
বিজয় তার হাতের ব্যাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে লাগলাে। নীরুও
পাগলের মত তাকে ব্যাটের বারি মারতে লাগলাে। চিতাটাও ক্রমশঃ লাফাতে লাফাতে নিস্তেজ হয়ে পড়লাে। এইবার বিজয় দৌড়ে গিয়ে নাইলনের দড়ি নিয়ে এসে নীরুর সাহায্যে বেশ ভালভাবে বেঁধে ফেললে। অজয় বললে ওর মুখের মধ্যে একটা বল ঢুকিয়ে দে,
যাতে চিতাটা কামড়াতে না পারে। বিজয় সেই মত করলাে। এত সহজে যে
চিতাটাকে ওরা কজা করতে পারবে তা ভাবতেই পারলাে না।
কিভাবে চিতাটাকে রেখে বিজয়, অজয়ের হাতটা পরীক্ষা করে দেখলাম অজয় বললে চোটটা বেশ ভালই লেগেছে রে। আমার এভাবে অন্যমনস্ক হওয়া উচিত হয়নি। আমি ভেবেছি জালের মধ্যে রয়েছে তাে। অতএব ক্যাজুয়েলি ওর সামনে এগিয়েছি, যেটা মােটেই উচিত হয়নি।
নীরু বললে দাদারা তােমরা অপেক্ষা করাে। আমি লােকজন নিয়ে এক্ষুণি আসছি। নীরু ছুটে চলে গেল।
বিজয় অাকে কিছু চোটের ওষুধ খাইয়ে দিল। অজয়ের হাতের বর্মটা খুলে টেনে দেখতে গিয়ে অজয়ের আর্ত চিৎকারে বোঝা গেল চোটটা বেশ ভালই লেগেছে। একটা কাঠের ছােট্ট প্লেট নিয়ে হাতটা জোরে চেপে বেঁধে দিল।
ইতিমধ্যে নীরু লােকজন নিয়ে হাজির। সবাই হৈ হৈ করে চিৎকার করছে। নীরু সবাইকে চুপ করতে বলে চিতাটাকে দেখালাে। দেখা গেল বাঘের জালের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে আর খানিকটা নিস্তেজও বটে।
নীরুর লােকেরা জঙ্গল থেকেই বাঁশ কেটে নিয়ে এসে ঐ বাঁধা চিতাটাকে বাঁশ দিয়ে বেঁধে রাখলাে এমনভাবে যাতে কাধে করে সবাই মিলে নিয়ে যেতে
পারে।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 7
নীরু তার লােকেদের নিয়ে তাবু এবং অন্য সব জিনিষ গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হলাে। এমন সময় হঠাৎ ছাগল ডাকার আওয়াজ পাওয়া গেল। সবাই থতমত খেয়ে গেছে। কি ব্যাপার এখানে ছাগল আবার কোথা থেকে এলাে।
অজয়, বিজয়, নীরু হেসে উঠলাে। চিতাটা লাফালাফিতে টেপটা বন্ধ হয়ে
গিছলাে। আবার বাঁশ দিয়ে বাঁধার সময় টেপটা চালু হ'য়ে যায়। সেই টেপটা রয়েছে আবার চিতাটার ঘাড়ের কাছে। সেখান থেকে বার করতে হবে। নীরু বললো দাঁড়াও আমি বার করছি। একটা উইকেট নিয়ে ঘাড়ের তলায় দিয়ে ঘাড়টাকে একটু তুলে হাত দিয়ে বার করে আনলাে। চিতা ভায়ার আর নড়ার
ক্ষমতা নেই। তার সারা শরীর বাঁধা মুখের মধ্যে ডিউজ বল। সব গােছানাের পর চিতাটাকে কাধে তুলে সবাই হৈ হৈ করে চলেছেতাদের
শ্লোগান হচ্ছে"চলো-চলো, এগিয়ে চলাে-চিতাকে নিয়ে এগিয়ে চলো।”