Monday, September 28, 2020

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান

নীরাজনা ঘোষ



অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভালো ভাবে লক্ষ্য করে এবং কলেজ ছুটির পর একই সঙ্গে বাড়ি ফেরে। দু'জনের শরীরচর্চা একই সঙ্গে। খেলা ক্রিকেট। দু'জনেই দুর্দান্ত। 
কলেজে ওদের বন্ধু-বান্ধব সীমিত। যাদের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব কেবল। ওদের দু'জনেরই হবি' বলতে ভ্রমণ কাহিনী। আর সেটা যদি জঙ্গলের হয় তাে কথাই নেই। একজন একটা বই পেলে সে পড়ে নিয়ে অপরকে পড়াবে। এইভাবেই ওদের চলছে।

হঠাৎ অজয়ের খেয়াল হলাে, ওরা শিকারে যাবে। কি শিকার করবে? 'বাঘ'।

তাও আবার বন্দুক দিয়ে নয়। ওদের যে ব্যাট বল আছে, তাই দিয়েই বাঘকে পিটিয়ে মারবে।

দু'জনে মিটিং-এ বসলাে। কিভাবে যাবে, কোথায় যাবে। সব চেয়ে বড় কথা কিভাবে বাঘকে ওরা আক্রমণ করবে, কিভাবে প্রতিহত করবে। প্রচুর আলােচনা হলাে। ওরা সঙ্গে নেবে দু’জনের দুটো করে চারটে ব্যাট, দু ডজন ডিউস্ বল। ছ'টা উইকেট। যেকোন লোক হঠাৎ দেখলে ভাববে যে, এরা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছে।

বড় অদ্ভুত রকমের শিকার অভিযান। এ তাে 'গিনিস বুক-এ ওঠার মতাে ব্যাপার। অজয়ের যুক্তি বা বক্তব্য যাই বলা যাক না কেন, সেটা হচ্ছে শিকার তায় আবার বাঘ'। এতাে একটা 'এ্যাডভেনচার।-এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চারের মতই


শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী

হওয়া উচিত। তাতে যদি থ্রিল না রইল, তবে আর এ্যাডভেঞ্চার কিসের। আর রিস্ক। সে তাে থাকবেই। বন্দুক থাকলেও থাকতো। বরং বন্দুকে গুলি না বেড়ােতে পারে, কিন্তু হাতের ব্যাটের পিটুনী থেকে বাঘ নিস্তার পাবে না। আর এটা খুব কাছ থেকেই হবে। অতএব ঠিক মত যদি ব্যবহার করা যায় তাে বাঘ মশায় বুঝতে পারবে যে এতদিন বন্দুকের গুলির ভজন ছিল, এখন হচ্ছে ব্যাট বল, উইকেট।

সত্যিই জিনিষটা বেশ অদ্ভুত ধরণের। ওরা এবার আলােচনায় বসলাে। সঙ্গে কি কি নেবে, এদের কৌশল কি হবে? সবচেয়ে প্রথম এবং বড় হচ্ছে মনােবল। বাঘের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ। লােকে শুনলে বলবে যে, এদের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এদের রাঁচীর পাগলা
সুন্দরবনে শিকার অভিযান


গারদে পাঠাতে হবে। যাই হােক, কথা যখন উঠেছে, দুজনেই একমত হয়েছে তখন যেতেই হবে। আর খুব সাবধানে। সবচেয়ে বড় কথা হবে বাইরের কাউকে জানানাে হবে না যে, এরা এইভাবে শিকারে যাবে। তাহলে সবদিক থেকেই বাধা আসবে। প্রশাসন

ভেবে নেবেই যে, এরা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।

অতএব সব চুপচাপ। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাদের বলা হবে যে, ওরা বাইরে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে। একথা সবাই বিশ্বাসও করবে। কারণ সঙ্গে ক্রিকেটের সব রকম সাজসরঞ্জাম রয়েছে।

সরঞ্জাম ঃ চারটে ব্যাট বেশ মজবুত হওয়া চাই। দু ডজন ডিউস বা ছ'টা উইকেট। তিনসেলের দুটো টর্চ। দুটো হেড টর্চ—যে টর্চগুলাে সাধারণতঃ কোলিয়ারীতে ব্যবহার করা হয়। চারটে করে আটটা হ্যাণ্ডস্ গ্লাব। চারটে প্যাড। দুটো তাবু খাটাবার সবকিছু জিনিষ। তীক্ষ্ণ শব্দের দুটো হুইস। যাত্রায় যুদ্ধের দৃশ্যের সময় যেমন বর্ম পড়ে, সে রকম বুক, পিঠ ও হাতের

বর্ম। বড় শক্ত জাল দুটো।

চারটে ক্রিকেট হেলমেট। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, ব্যাণ্ডেজ ইত্যাদি। এইরকমের আরও উদ্ভট উদ্ভট সব জিনিষ। এই বাঘ শিকার করতে যেতে হবে খুবই সাবধানে। কারণ বাঘ হচ্ছে খুবই বুদ্ধিমান জীব। তাকে বােকা বানিয়ে

বেকায়দায় ফেলে আক্রমণ করতে হবে। এবার কৌশল ঠিক করতে হবে কিভাবে বাঘ কে বােকা বানানাে যায়। প্রথমে কোথায় তাবু খাটানাে হবে। দুটো তাবু খাটানাে হবে। একটা নিজেদের জন্য আর একটা বাঘ বােকা বানাবার জন্য।
বাঘের জন্য যে তাবু খাটানাে হবে, সেই জায়গাটা হবে, বাঘ সাধারণতঃ যেখানে আসবেই, অর্থাৎ জল খেতে। সেই রকম জায়গা দেখে এমনভাবে তাবু খাটাতে হবে যাতে সহজেই বাঘের চোখে পড়ে। সেই তাবুর মধ্যে বাঘকে আটকে ফেলার জন্য ফাদ পাতা হবে, বেশ শক্ত

জাল দিয়ে।



আর নিজেদের তাবু খাটানাে হবে এমন জায়গায় যেখানে সহজে লােকের বা জন্তুদের নজরে পড়বে না। তাবুর চারপাশে গাছ-গাছালির ঝােপ থাকবে। তার মধ্যে নিজেদের শােবার, খাওয়ার সব জিনিষপত্র থাকবে। বাঘের তাবুর ঠিক পেছনে থাকা চাই একটা গাছের জঙ্গল। যে দিক দিয়ে বাঘ

সহজে বেরােতে পারবে না। সেই দিকেও একটা জাল টাঙ্গানাে থাকবে। যদি বাঘ তাঁবুর ভেতর না ঢুকে বাইরে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে বাইরের জালে সে আটকা পড়বে। তারপর তাকে এদের হাতে পড়তে হবেই।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 2

সেই তাবুর পেছনে গায়ে গায়ে একটা আলাে এমনভাবে রাখা হবে যাতে সহজেই তাবুটা বাঘের নজরে আসে। আর এরা দু'জনে দুধারে গাছের আড়ালে ব্যাট এবং বল, উইকেট নিয়ে দু'ভাগে অপেক্ষা করবে। ওই বলগুলােকে ব্যবহার করা হবে অনেকটা গুলির মতন করে। দূর থেকে বলটা এমন ভাবে ছোঁড়া হবে যাতে সেটা বাঘের গায়ে জোরে আঘাত করে এবং সেই আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যেন সে তাঁবুর দিকে আসে।

প্রয়ােজনে উইকেটটা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে সেটা তার মুখের মধ্যে সােজাসুজি ঢুকে যায়। আবার প্রয়ােজনে বাঘ যখন হাঁ করে এগােতে থাকবে, তখন সেই হাঁ লক্ষ্য করে তীব্র বেগে বলটা মুখের মধ্যে ছুঁড়তে হবে। আর এটাও খেয়াল রাখতে হবে বাঘ যখন লাফ দেবে ওই অল্প সময়ের মধ্যে বল ছুঁড়ে খুব তৎপরতার সঙ্গে পাশে সরে গিয়ে বাঘকে আক্রমণ করতে হবে, অনেকটা ক্যারাটের মত দ্রুতগতিতে, যাতে বাঘ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘায়েল করা যায়।

প্রথম পর্যায়ে এই আলােচনা হলে। এর জন্য যে দ্রুতগতি তৎপরতার প্রয়ােজন, সেটা দু বন্ধুতে মিলে রােজ সকাল বিকেল অনুশীলন করতে লাগলাে। ওদের এই রকম হঠাৎ একটা বিষয়ে অনুশীলন করতে দেখে ওদের বন্ধুরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় ওরা বলেএমনি প্র্যাকটিস্ করছি। বহুদিন করিনি তাে,

যাতে মরচে পড়ে না যায়। তাই একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। নিজেদের সাংঘাতিকভাবে তৈরী করছে। শরীরটাকে ইস্পাতের মত শক্ত করেছে। চোখের দৃষ্টি প্রখর করতে হয়েছে। ক্ষিপ্রতা দারুণভাবে বেড়েছে। এতে দু-জনেই খুব সন্তুষ্ট।

এইবার এরা দুজনে দু’জনকে ঠিক বাঘের আক্রমণ করা এবং তা থেকে

নিজেদের বাঁচার পদ্ধতি, ক্ষিপ্রতা, এই সমস্ত ঠিকমত আয়ত্তে আছে কিনা পরীক্ষা করে নিচ্ছে। প্রায় ঠিকই হয়েছে। এবার একটা ভাল দিন দেখে যাত্রা শুরু করতে হবে।

ওরা ঠিক করেছে সুন্দরবনের দিকে যাবে। ওদিকে অনেক ছােট ছােট খাড়ি




আছে। তার একটাতে ঢুকে নিজেদের সুবিধা মত জায়গা দেখে শুনে আস্তানা

ঠিক করবে। বেশ ভালভাবে নিজেদের জিনিষপত্র ঠিক আছে কি না, দেখেশুনে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাে। আবার নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছে, বার বার আলােচনা করার অর্থই হচ্ছে, আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছু সুবিধে

অসুবিধে ধরা পড়ে। সেগুলি আবার ঠিকঠাক করে নেওয়া যায়।

এবার ওদের যাত্রা হলাে শুরু। প্রথমে ক্যানিং। ক্যানিং থেকে একটা ছােট্ট

ভুটভটি নিল। একান্ত নিজেদের জন্য। ভোটাভোটির চারজন লোক। তার মধ্যে নীরু মণ্ডল বলে একজনকে পাওয়া গেল। তার সঙ্গে কথা বলে এটুকু বােঝা গেল যে, নীরুর সুন্দরবনের এইসব খাড়ির সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। নীরু মাঝ বয়সী। শক্ত সামর্থ চেহারা। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করা গেল যে, নীরু মণ্ডল জাতে মুসলমান হলেও হিন্দু দেবদেবীদের খুব মানে, আর কথায় কথায় হাত তুলে বনদেবীকে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করছে। অজয় বিজয়ের নীরুকে খুব ভাল লাগলাে। ওকে নিজেদের একজন করে

নিল। ওকে বললাে যে, ওরা খুব কাছ থেকে বাঘকে দেখতে চায়। আর যদি

সেরকম অবস্থার মুখােমুখি হতে হয় তাে তখন নিজেদের বাঁচাবার জন্য যা করার সে তাে করতে হবেই। নীরু বলছে দেখুন বাবু'। এই বাবু' কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অজয় বললে দেখা নীরুদা, তুমি আমাদের বাবু বলে ডাকবে না তবে কি বলবােনীরুর প্রশ্ন। কিছুক্ষণ ভেবে বলল বেশ, তােমরা যখন আমায় দাদা

বলে ডাকছে আমিও তােমাদের দাদা বলে ডাকবাে। তােমায় অজয় না বলে আজুদাদা আর তােমায় বিজয় না বলে বিজুদাদা বলবাে। এই কথাগুলাে বলতে বলতে নীরু কেঁদে ফেললাে। চোখ মুছে বলল—দাদা এভাবে কেউ কিন্তু আপনাদের মত 'দাদা বলে আমায় কাছে টেনে নেয়নি।

বিজয় বাধা দিয়ে বলল—আবার আপনি কেন? বেশ তাে হচ্ছে।

নীরু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেআর হবে না দাদা। ভুটুভটি চলছে। আর নীরুর সঙ্গে সুন্দরবনে বাঘেদের সম্বন্ধে বহু কথা শুনছে।

এও শুনলাে যে, এখানে চোরাশিকারীরা এসে বাঘের অন্যায়ভাবে মেরে তাদের চামড়া বাইরে বিক্রী করছে বেশী দামে। শুধু শুধু মারার কোন মানে হয়। তারাও তাে ভগবানের জীব। তারা নিজেরা চরে বেড়াচ্ছে, নিজেদের মত। যদি তােমাদের কারুর কোন ক্ষতি করে তাহলে না হয় কথা। 

সে তােমার কোন ক্ষতি করলাে না। তােমার খেয়াল খুশী মেটাবার জন্য একটা নিরীহ জন্তুর প্রাণ নিচ্ছ। এটা কি ঠিক দাদা, তােমরা তাে লেখাপড়া শিখেছাে, আমার চেয়ে অনেক বেশী। নীরুর কথাগুলাে শুনে অজয় বিজয় চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। খুবই সত্যি

কথা। ওদের বাঘ শিকার করা এক রকমের নৃশংসতা। বাঘটা জল খেতে বা বেড়াতে এসেছে। আর ওরা তাকে নিজেদের বুদ্ধি, শক্তি দিয়ে পিটিয়ে মারবে।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 3


তবু বিজয় বললে আচ্ছা নীরুদা, তুমি বাঘকে কি বলে 'নিরীহ বললে। নীরু ঠিক বলেছেন, নিরীহ আমি এই জন্যে বলছি যে, বাঘ কিন্তু তার প্রয়ােজন না হলে শুধু শুধু কারুর ক্ষতি করবে না। শুধু বাঘ কেন, কোন জন্তুই শুধু শুধু অন্য কারুর ক্ষতি করে না, তা যদি করতাে, তাহলে বনে আর জন্তু বলে কিছু থাকতাে না, যার ক্ষমতা বেশী সেই রাজত্ব করতাে। 


আর তুমি যদি বলাে যে, বাঘ তাে হরিণ বা ওই ধরণের আরও নিরীহ জন্তুদের মেরে খাচ্ছে। সেটাও ঠিক। ওটা জানবে ভগবানের বিধান। তার প্রাণ ধারণের জন্য তাকে করতে হচ্ছে। আবার দেখাে, হরিণও লতাপাতা খাচ্ছে। খেয়ে জীবন ধারণ করছে। লতাপাতাও তাে ভগবানের দান। এগুলাে একের জন্যে আর একজনের সৃষ্টি। = অজয়—আমার মনে হয়, ওর পড়াশুনা আছে। তার মানে এই নয় যে,

নীরু কথাবার্তা, যুক্তি সব শুনে অজয় বিজয়ের চমক লেগে যায়। নীরু নীচে থেকে আসছে তাদের চা জলখাবার নিয়ে এই বলে চলে গেল। বিজয় বললে, দেখ অজয়? নীরুদাকে আমরা যতটা সাধারণ মনে করি, ঠিক ততটা নয় কিন্তু।

ইউনিভারসিটি ষ্ট্যাম্প। বিজয়—ইউনিভার্সিটি ষ্ট্যাম্প তাে রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না। তবে

অজয়-না, আমি বলছি, নীরুদার বাইরের জ্ঞান বেশ ভালই। অনেকের চেয়ে যথেষ্ট বেশীই বলতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করবাে, ও কতদূর পড়াশুনাে করেছে। বিজয়সে তাে হলাে। কিন্তু নীরুদার কথা শোনার পর কি আর ওইভাবে

পিটিয়ে শুধু শুধু বাঘ মারার কৃতিত্ব নেওয়া সম্ভব হবে। বিশেষতঃ নীরুদা সঙ্গে

থাকতে। অজয়ের, তাতাে বটেই। তবে দেখা তাে যাক, শেষ পর্যন্ত আমাদেরই এমন

একটা পরিস্থিতি তৈরী করতে হবে, যাতে নীরুদার ঐ মতটা যেন কাজে লাগে।

বিজয় কোন মতটা! অজয়—ঐ যে ক্ষতি না করেও তাকে হত্যা করা।

বিজয় এটা কিন্তু ঠিক অজয়, মানুষ ভগবানের শ্রেষ্ঠ জীব। সে তার খেয়াল

চরিতার্থ করার জন্য যা খুশী তাই করেছে এবং করবেও। এমন সময় নীরুদা তাদের জন্য চা, মুড়ি, নারকেল, তেল দিয়ে মেখে নিয়ে এলোরে।নওগাঁ দাদারা তােমাদের জলখাবার।

অজয় বিজয় মুড়ি, নারকেল দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাে। ওঃ নীরুদা, তুমি কি করছো। সাংঘাতিক! অনেকদিন পরে ..... আরে তােমার কই?

নীরু আমতা আমতা করে বললে আমি পরে খাবে। তোমরা তো আগে খাও। বিজয় না, আগে তােমারটা নিয়ে এসাে, তবে আমরা খাবাে। খেতে খেতে

গল্প করবো।


নীরু তবুও আমতা আমতা করতে, অজয় টেনে তুলে দিয়ে ওকে নিচে পাঠিয়ে দিল—তার খাবার আনার জন্য। সামান্য পরে নীরু শুধু মুড়ি নিয়ে এসে পাশে বসলাে। সেটা দেখে অজয় বললেনীরুদা নীচে থেকে দুটো কাঁচা লঙ্কা নিয়ে এসাে না গাে। তােমায় বলতে

ভুলে গেছি।

এই আনছি বলে নীরু নীচে গেলে অজয় নীরুর মুড়ির পাত্রটা নিয়ে নিজেদের সঙ্গে ভালাে করে মিশিয়ে ওর পাত্রে ওর ভাগটা রেখে দিল। নীরু লঙ্কা নিয়ে এলাে। বিজয় বলল দাঁড়াও, মনে হচ্ছে আমার কিট্স-এর মধ্যে চানাচুরের প্যাকেট আছে নিয়ে আসি। 

বলে নিচে গিয়ে চানাচুর নিয়ে এসে তিনজনের খাবারের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে একসঙ্গে খেতে বসলাে। এদের ব্যবহার দেখে নীরু এতই বিহ্বল হয়ে পড়েছে যে, খেতেই ভুলে গেছে। অজয়, বিজয় তাড়া লাগাতে খেতে বসলাে। তারপর নীরুদা বিজয় বললে তােমার কথা আমরা সত্যিই এতক্ষণ

আলােচনা করছিলুম যে, সত্যিই তাে বাঘদাদা যদি আমাদের কোন ক্ষতি না করে তাহলে আমরা শুধু শুধু কেন তাকে মারতে যাবাে! এইরকম গল্প চলছে, আর ভুটভটি ছুটছে। হঠাৎ পাশ একটা নৌকো থেকে

২।৩ জন নীরুকে দেখে চিৎকার করে উঠলো, নীরুদাদা, নীরুদাদা', এইরকম

অনেক ভাবে তাকে ডাকছে। নীরু ভটভটি থামালাে।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4

নৌকার লােকদের মধ্যে একজন বললেনীরুদাদা তােমার খোঁজেই আমরা বেড়িয়েছি। কেন রে কি হয়েছে, নীরুর প্রশ্ন

সতীশ জেঠুর নাতিটাকে একটা চিতায় মেরে

গেছে।

সে কি রে?' কি করে হলো এই অঘটন? ঐ বাচ্চাটা পাশের মাঠে খেলা করছিল-হঠাৎ রে রে শব্দ। কি?—না, সতীশ জেঠুর নাতিকে চিতাটা মেরেছে। বে নিয়ে যেতে পারেনি। খুব জখম

করেছে।

নীরু অজয় বিজয়কে বলে দাদারা, আমার আর তােমাদের সঙ্গে যাওয়া হ'লাে না। আমায় এখনই এদের সঙ্গে যেতে হবে। বিজয়—আমাদের গ্রাম কতদূর এখান থেকে? নীরুতা মাইল পাচেক হবে। অজয়নীরু সারেংকে ভট্ভটি ঘােরাতে বলাে। আমরাও যাবাে ওই গ্রামে।

আর তােমার নিরীহ চিতাকেও দেখবাে! নীরু আর কোন কথা না বলে সারেংকে ভটভটির গন্তব্যস্থল বলে নৌকোর


লােকদের বললে তারা আমাদের ভটভটিতে উঠে আয়। আমরা সবাই যাবাে। নৌকার লােকেরা তাড়াতাড়ি ভটভটিতে উঠে পড়লাে। ওরা যখন সেই গ্রামে পৌঁছলাে, দেখলাে যে, নদীর মাঠে অন্ততঃ কমপক্ষে পঞ্চাশজন বিভিন্ন বয়সের লােক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা নামতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলাে।

অজয় বললেন দাদা, আগে তােমাদের সতীশ জেঠুর বাড়ি চলাে। সেখানে পৌঁছে দেখে, বৃদ্ধ সতীশবাবু কিরকম চুপ চাপ বসে রয়েছে। ছেলেটাকে কাছাকাছি ডাক্তারখানায় নিয়ে গেছে।

গ্রামের লােকেদের জিজ্ঞেস করলাে যে, চিতাটা এখন কোথায় থাকতে পারে? ওরা পাশের একটা আধা জঙ্গল গােছের জায়গায় ওদের নিয়ে গেল। সবাইকে চলে যেতে বলে অজয় নীরু দাদাকে বললে, তুমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারাে। নীরুও বললেতােমাদের একলা ফেলে আমি যাবােও না।

অজয়, বিজয় সব জিনিষপত্র নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিকে চললাে। সঙ্গে নীরুও চলেছে। সামনে একটা জল রয়েছে। পাশে খানিকটা ফাকা মাঠ রয়েছে। সেখানেই সব জিনিষপত্র রেখে, প্রথমেই একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বিজয়কে অজয়

বললেতুই তৈরী হ'য়ে নে, আমি আশপাশটা একটু ঘুরে আসছি। বলে সামনে

এগিয়ে গেল। এদিকে বিজয় খুব তাড়তাড়ি সব জিনিষপত্র বার করে নিজেকে বর্ম, হেলমেট দিয়ে কভার করে ফেললাে, নীরু ও তাকে সাহায্য করেছে। 

ওইখানেই একটা তাবু দু’জনে খুব তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে ফেললে। ভেতরে নীরুকে নিয়ে একটা জালও পেতে রাখলাে।

অজয় কিছুদুর গিয়ে পাশ থেকে কিরকম যেন একটা গন্ধ পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে

সতর্ক হয়ে গেল। চারপাশ বেশ ভাল করে দেখবার চেষ্টা করলাে। কিছুই বােঝা যাচ্ছে না। কারণ, এখানে বেশ অন্ধকার মতন। দিনের বেলা হলেও খুব একটা পরিষ্কার নয়।

 ফিরে এলাে। এসে দেখে তাবু খাটানাে হয়ে গেছে। অজয় একবার ভাল করে দেখে নিয়ে নিজে এবার তৈরী হয়ে নিল।

অজয় বললেআমি গন্ধ পেয়েছি। চিতাটা খুব কাছেই আছে। এবার সে একটা বড় টর্চ বার করে পেছনের গাছটার গায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলাে যাতে ঐ জায়গাটা অন্ততঃ আলােকিত হয়ে থাকে। আর তাঁবুর সামনে-সামনের দরজাটা অল্প একটু খুলে রাখলাে।

বিজয় এবং নীরু বললে যে, চিতা কিন্তু খুব বুদ্ধিমান এবং ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন

হয়। অতএব চারদিকে নজর রাখতে হবে। অজয় নীরুকে একটা ব্যাট দিয়ে বলল—এটা হাতে রাখাে। খুবই জোরালাে

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4


এবং শক্ত করে। চিতা যেই লাফ মারবে, খুব তাড়াতাড়ি তুমি যেখামে আছাে তার থেকে দু-পা সরে গিয়ে সজোরে চিতার মুখে মারবে। কিভাবে মারবে সেটা অজয়

দেখিয়ে দিল। ওইটা যদি ঠিকভাবে চিতার চোয়ালে লাগে তাহলে ও এক ঘায়েই ঘায়েল হবে। অবশ্য তােমায় এতটা কষ্ট করতে হবে না, আমরা তাে এখানেই রয়েছি।

এই বলে অজয়, নীরুকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় রেখে দু'জনে তাঁবুর

দু'পাশে রইল। আর তাবুর ভেতরের জাল থেকে দু'ধারে দুটো দড়ি বার করে

রাখলাে ঠিক মত টানতে হলাে।

আর যদি টানার মত সুযােগও না আসে, তবুও চিতা তার ক্ষিপ্রতার জন্যই

আরাে জালে জড়িয়ে পড়বে। যত বেশী লাফালাফি করবে, তত বেশী জড়াবে। এইভাবে সব গুছিয়ে ফাঁদ পেতে রাখা হলো। নীতু বললেআজুদাদা, তােমাদের আর একটা জাল রয়েছে। ঐ জালটা

আমায় দাও, আমি তাে বহুবার মাছ ধরেছি। আমি এই ব্যাট চালানাের চেয়ে খুব

তাড়াতাড়ি জাল ফেলতে পারবাে। অজয় তাতে রাজী হয়ে ওকে একটা জাল দিয়ে দিল। তারপর নিজেদের বৃসার একটা জায়গা করলাে, ওই তাবু থেকে তার পাশেই সামান্য দূরে, যেখান থেকে তাবুটা বেশ দেখা যায়, সেরকম জায়গায় নিজেদের তাবুটা চটপট খাটিয়ে ফেললে। আর নীরু আবার পাশ থেকে গাছের ডাল পাতা ভেঙ্গে এনে বাবুর মাথায় চারপাশে এমনভাবে রাখলাে যে, দূর থেকে এটাকে আর তাবু বলে মনেই হবে

না। নীরুকে সাহায্য করলাে বিজয়। অজয় তাবুর ভেতর তাদের ফোল্ডিং টুল, টেবিল বার করে খাবার ব্যবস্থা করেছে। বিজয় আর নীরুকে ভেতরে ডেকে এনে বললে সব তাে ঠিক

হয়েছে এবারে পেটের ব্যবস্থা করা যাক আর আমি নিশ্চিন্ত যে, চিতা মহারাজ

কাছে পিঠেই আছেন। তার দর্শন পেতে আমাদের আর বেশী দেরী হবে না। কারণ,

ওই চিতাটা খানিকটা রক্তের স্বাদ পেয়েছে, আর ক্ষুধার্তও বটে। আমি তার গায়ের বা গন্ধ পেয়েছি। কিন্তু সবাইকে বেশ সতর্ক হয়ে থাকতে হবে সব সময়। তিনটে পেটে তিনজনের খাবার গুছিয়ে অজয় বললে দুটো পেটে তা দিতে হবে। শক্তি সঞ্চয় করতে হবে তাে, নাহলে চিতা-রাজের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে কি করে? নীরু ওদের সাজসরঞ্জাম দেখে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেছে। প্রথমটা ওদের

কথা মত কাজ করলেও পরে বুঝলাে যে, এটা যেন ছেলেখেলা হচ্ছে। আগুন নিয়ে খেলা। মৃত্যুর সঙ্গে ছেলে খেলা। শেষে খেতে খেতে বলছে আচ্ছা, আজু


ভাই, তােমরা যে এইভাবে সেজেছাে, এতাে যাত্রায় যখন-যুদ্ধ হয় তখন এইসব সাজ হয়।

অজয়ের দাদা, এটা তাে আমাদের একটা যুদ্ধই। আর আমরা বন্দুক

ব্যবহার করবাে না এই জন্যে যে, আমরা চাই বাঘের সঙ্গে সামনা-সামনি লড়তে।

অবশ্যই এখানে বুদ্ধিই হচ্ছে আমাদের বন্দুক। নীরু সবই তাে বুঝলাম, কিন্তু আমার মনে কি করম যেন বাধাে বাধাে ঠেকছে।

বিজয় নীরু দাদা, তােমায় আমি গােড়া থেকে বেশ লক্ষ্য করেছি এবং এখনও

করছি। তুমি একটা সত্যি কথা বলবে আমাদের!

নীরু সত্যি কথা! আমি তাে কোন মিথ্যা বলিনি তােমাদের। আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু Not a liar'। O a check You are not a liar, but সত্যি করে বলাে

তাে তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছেন।এখানে তুমি আমাদের ধন্দে রেখেছে। নীরু যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। "লজ্জার কি আছে, নীরু দাদা অজয় বললে বিদ্যা সকলের জন্য। এটা

কেউ নিজের বলে আঁকড়ে থাকতে পারে না। সেই পারে যে তাকে সত্যি সত্যি কাজে লাগাতে পারে। আর এটা তাে কারুর নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। শিক্ষা এমনই যে, যার আকাঙ্া আছে সে খুব বিরাট কিছু বিদেশ বিভূইতে গিয়ে শিক্ষা নেবে, তা না হতে পারে কিন্তু একটা নিম্নমান আছে যেখানে ইচ্ছা থাকলে সেটা করা যায়, অবশ্যই বেশ কষ্ট হয় তা জানি। তা তােমার নিম্নমানটা কি শুনি। নীরু আস্তে আস্তে মুখ তুলে বললে হায়ার সেকেন্ডারী পড়েছি কিন্তু পরী দেওয়া হয়নি।

অজয় কারণ? নীরু—কারণ যা, তা খুবই সাধারণ অন্যের কাছে কিন্তু অসাধারণ আমাদের মত গরীবদের কাছে।—“অভাব'।

বিজয়-খুবই কমন্ যা, তাই—অভাব। যেটা আমাদের সমাজে খুবই কম। এই অভাবের জন্য কত কি হয়ে যাচ্ছে। মা তার সন্তানকে বেচে দিচ্ছে, যুবতী মেয়ে তার ইজ্জত রাখতে পারছে না। বাবা বিষ খাইয়ে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে হত্যা করে কোথাও নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে আবার কোথাও গিয়ে পুলিশে সরাসরি ধরা দিয়েছে। এই অভাবই আমাদের খেয়েছে, খাচ্ছে এবং খাবেও। আর কতদিন যে আমরা এই অভাবের পোস্টার বুকে পিঠে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবাে তা জানি না। এক এক সময় খুবই বাজে লাগে।



নীরু খুবই সত্যি কথা বিজু দাদা। এই অভাবই আমাদেরমানে

মধ্যবিত্ত সমাজের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দিয়েছে।

এই

অজয়—বীরু দাদা, তুমি যদি কিছু মনে না করাে তাে তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে! সেখানে গিয়ে তুমি পড়াশুনা করবে।

নীরু ইচ্ছে তাই করে আজুদাদা, কিন্তু উপায় কোথায়। আলো কোথায়।

বিজয় অন্ধকারের পেছনেই সে আছে। অন্ধকারে জোর করে সরিয়ে দাও। দেখবে আলো ঠিক এসে পড়েছে। আর দেখাে, আলো হচ্ছে এমনই এক জিনিষ, যে, তাকে সাধ্যি সাধনা না করলে তার দর্শন পাওয়া যায় না। তাইতাে কবি

বলেছেন—“আলো, আলো আমার জীবন..” দেখাে, আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছে, আমরা গল্পে মেতে রয়েছে কি একটা যেন খস্ খস্ আওয়াজ হলাে না? সবাই সন্ত্রন্ত্র হয়ে উঠলাে। তাবু থেকে খুব সাবধানে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করেও কিছু দেখতে পেল না অজয়। ফিরে এসে বললেআমাদের খাওয়া যা হােক হয়েছে একরকম। এবার এদিকে একটু নজর দিতে হবে।

মহারাজের আবির্ভাব হয়তাে হতে পারে। বিজয় বললে হয়তো না-ও হতে পারে।

নীরু হঠাৎ প্রতিবাদ করে উঠলো"না বিজি দাদা, না। সতীশ জেঠুর অবস্থাটা তাে দেখেছাে নিজের চোখে। ছেলেটার কি অবস্থা তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। তবে এই চিতাকে আমি ছাড়বাে না।

অজয় তাকে পেলে তবে তাে। নীরুতাকে যে পেতেই হবে। এই চিতাটা ভয়ানক উপদ্রব শুরু করেছে। হরেন কাকার একটা বাছুর মেরেছে। বড়ে মিয়ার একটা ছাগল নিয়েছে। গ্রামের মধ্যে লােক নিশ্চিন্তে ঘােরাফেরা করতে পারছে না। তাকে পেতেই হবে। আমাকে, পেতেই হবে।

বিজয় সে তাে নিশ্চয়ই, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নীরু হ্যাঁ, সে তো বটেই। তবে শুভ লক্ষণ যে, আজু দাদা তার গায়ের গন্ধ যেমন পেয়েছে, সে-ও আমাদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে। অতএব সে আশেপাশেই কোথাও আছে। সুযােগ বুঝে সে ঠিকই তার কাজ হাসিল করার চেষ্টা করবে। - তবে, আমার মনে হয়, বাইরের ওই টর্চটা নিভিয়ে ছােট একটা আলাে যদি ওই

তাবুটার আশপাশে থাকে তবে অনেকটা জুতার মত লাগবে, তাবুটাও দেখা যাবে।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 5


অজয় উঠে গিয়ে ওই টর্চটার সামনে কয়েকটা গাছের পাতার আড়াল করে দিল তাতে আলোর তীব্রতা চলে গিয়ে একটা স্নিগ্ধতা নেমে এলাে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে এলাে। সবাই সতর্ক হ'য়ে উঠলাে। যেকোন মুহুর্তে তাদের অ্যাকশানে নামতে হবে। আর এ যে সে অ্যাকশন নয়। চিতার সঙ্গে সম্মুখ সমরে। নীরু বললে-আজুদাদা, আমাদের কিন্তু ওপরের দিকে নজর রাখতে হবে

কারণ চিতা গাছের ওপরও লুকিয়ে থাকে, সময় বিশেষে।

“ঠিক বলেছেন, আমাদের ও দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। বলে বিজয় তাবুর বাইরে বেরিয়ে ওপর দিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে ওর কাছে যে পেন্সিল টর্চটা ছিল, সেটা জেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ ভালভাবে দেখছে। ও অবশ্য টর্চের মুখে ওর রুমালটা পাতলা করে চাপা দিয়ে রেখেছে, যাতে করে ওর তীব্রতাটা চিতার চোখে না পড়ে। হঠাৎ এক জায়গায় এসে ওর চোখ আটকে গেল। দেখা গেল কি একটা ঝুলছে। ভাল করে দেখেও বুঝতে পারছে না, ওটা কি ঝুলছে। আস্তে আস্তে অজয়কে ডাকলাে।

অজয় এবং নীরু দৌড়ে বিজয়ের কাছে দাঁড়াতে বিজয় ওই ঝােলা জিনিষটা

দেখিয়ে কি ওটা জানতে চাইলে নীরু বললে-দাদা, তােমার আশার জিনিষ এসে

গেছে। ওটা চিতাটার লেজ। ওটা সাপ নয়, তাহলে এতক্ষণে ওর মুখটা ওপর দিকে উঠে আসতাে। নীরুর কথা শুনে অজয় বললে, বিজয় অপারেশন এখনিই শুরু করতে হবে।

তুই আলােটা ঠিক এইভাবেই রাখবি। আমি যেই হুইসল বাজাবাে তুই অমনি আলাের মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিবি আর আমি বল চার্জ করবাে পরপর। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, তবে সবাই কিন্তু প্রস্তুত থাকবে। বলে অজয় ডিউজ বলের ব্যাগটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। ঐ আলােটা লক্ষ্য করে নিজে পজিশন নিয়ে খুব জোরে ওই বিদ্ঘুটে আওয়াজের হুইসল বাজালে!

সঙ্গে সঙ্গে রুমালের আড়াল সরে গিয়ে আলাে তীব্র হলাে এবং সেই সময়েই দেখা গেল একটা বল এসে ওপর দিয়ে চলে গেলফটাস্ করে একটা আওয়াজ হলাে আর গরু গর আওয়াজ করে কি একটা লাফিয়ে নীচে পড়লাে। এরা বড় আলােটা জ্বাললাে। কিছুই দেখা গেল না।

নীরু বললে, ভয় নেই বিজু দাদা। ওই চিতাটা চোট খেয়েছে, চোট খাওয়া চিতা খুব হিংস্র হয়ে যায়, আর সে তার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য আবার আসবে। আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

অজয় দৌড়ে ফিরে এলাে। বিজয় বলে—উইকেট ডাউন। চিতার গায়ে

লেগেছে, আওয়াজ পেয়েছি এবং সে লাফিয়ে পড়েছেও। তবে এখানে সে

আসবেই। অতএব আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অজয়তবে আমাদের এই তাবুর আশে-পাশেই থাকতে হবে। আর তাঁবুটা আরও লােভনীয় করে রাখতে হবে সেই চিতার আসার জন্যে।


নীরু-কিভাবে।

অজয় দেখবে না, বলে সে তার ব্যাটারী চালিত ছােট টেপ রেকর্ডারটা এনে চালাতেই একটা ছাগল বার বার ডাকতে শুরু করলাে। এই টেপটা ওই জালের মধ্যে থাকবে আর মাঝে মাঝে বাজবে আর সেই ডাকই হবে চিতা মহারাজের টোপ। তাকে এই তাবুর মধ্যে আসতে হবেই এবং এই জালে তাকে পড়তে হবেই। এবং

নীরু বাধা দিয়ে বলল এবং আমিই তাকে প্রথম পেটানাে শুরু করবাে। নীরুকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে। বিজয় ঠিক আছে, ঠিক আছে। নীরুদাদা এখন কিন্তু একদম উত্তেজিত হলে

চলবে না। আমাদের খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। একটু এধার ওধার হলেই সমূহ বিপদ।

অজয় বিজয়কে সমর্থন করে বলে—বীরু দাদা, তুমি, তাবুর এধারটায় থাকো, কারণ আমরা যেমন শরীরটাকে কিছুটা সুরক্ষিত করে রেখেছি, তােমার তাে তা নেই।

বিজয় বললে—কেন? নীরুদাদাকে একটা হেলমেট আর দুটো দস্তানা দিয়ে

দিলে, কিছুটা অন্ততঃ গার্ড হবে তাে। আর একটা বাঁশীও দিও। অজয় বলল হ্যা, হ্যা, ভুলেই গেছলাম যে, আমাদের এক্সট্রা একটা সেট রয়েছে। তবে বর্মটা নেই। নিল

নীরু বললো তাতে কি হয়েছে, এতেই হবে। নীরু নিজেকে হেলমেট আর দস্তানা দিয়ে তার হাতে ব্যাট রয়েছে।

সাজিয়ে

সবাই কান খাড়া করে রেখেছে। মাঝে মাঝে ছাগলের ডাকটা শােনা যাচ্ছে। নীরু হেসে ফেলে বলল সত্যি আজু দাদা তােমরা শহরের লােকেরা কত সহজেই একে অপরকে বােকা বানাতে পারাে।

নীরুর কথায় অজয়, বিজয় ওর দিকে তাকালে নীরু অপ্রস্তুত হয়ে বললে

দেখাে, আমি ঠিক সে ভাবে কথাটা বলিনি। তােমরা কিছু মনে করাে না। বিজয়-তুমি খুব সত্যি কথা বলেছাে নীরুদাদা, মানুষ যত বেশী শিক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের যত উন্নতি হচ্ছে, দেখাে মানুষ ততাে বেশী মানুষেরই শত্রু হয়ে

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 6

উঠছে। তা না হ'লে তােমরা দেখােরুগীর ওষুধ, "শিশুর খাদ্য, এ দুটোই হচ্ছে। মানুষের অতি প্রয়ােজনীয় জিনিষ। সেগুলোতেও এমনভাবে ভেজাল দিয়ে তার থেকে বিস্তর পয়সা লুটছে। আবার বড় বড় কোম্পানী বিভিন্ন রকমের 'সেন্ট অর্থাৎ গন্ধ আবিষ্কার করেছে। যেমন—কনি: ঘি, আম, লেবু ইত্যাদি বহু রকমের। আজেবাজে জিনিষের সঙ্গে সেই গন্ধ মিশিয়ে মানুষকে, মানুষই ঠকাচ্ছে। তােমরা ভাববে ও; কি সুন্দর দামী কফি খাচ্ছি, কি দামী ঘি খাচ্ছি, মনের সুখে খাচ্ছে

আর নিজেকে ক্ষয় করে ফেলেছো।





অজয় আর দেখাে, আজকাল, মানুষের সখের জিনিষ যেমন নিত্য নতুন বেড়ােচ্ছে, তেমনি নিত্য নতুন রােগেরও আবির্ভাব হচ্ছে। আর রােগের কোন বয়েস নেই। একটা তিন মাসের শিশু তারও হার্ট প্রবলেম। তার কতটুকুই বা হার্ট, তার আবার প্রবলেম।

বিজয়-হবে না-ই বা কেন? তার মা তাে ভেজাল খেয়েই বড় হয়েছে। তার

শরীরের ভেতরটা তাে ভেজালে ভরা। তারই শরীরের রক্ত, মজ্জা নিয়েই তাে

একটা শিশুর জন্ম। যার আসলটাই ভেজালে ভরা, পরেরটাকেও তার কিছুটা ভাগ

নিতে হবে তাে।

নীরুসাবধান! যে যার জায়গা নাও। মনে হচ্ছে মহারাজের আগমন হচ্ছে। দেখছেন না খুব খেয়াল করে শান্তা খস্ খস্ আওয়াজ শুনতে পাবে। সবাই খুব মনােযােগ দিয়ে সত্যিই একটা আওয়াজ পাচ্ছে। যেন কেউ অতি সন্তর্পণে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাে। সবাই ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত। 

তারা সবাই এবার নিশ্চিত যে, চিতা তাদের খুবই কাছাকাছি এসে পড়েছে। কারণ তার গায়ে গন্ধ সবায়ের নাকে গেছে। কিন্তু কোনদিকে আছে কেউ-ই বলতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। অজয় ফিস্ ফিস্ করে সবাইকে বলে দিল—চিতাটা জালে পড়লেই জালের দড়ি টেনে তাবু গোটা খুলে দিতে হবে। তারপরে হরদম বাঁশী বাজিয়ে যাবে

সবাই। দেখতে দেখতে দেখা গেল চিতাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। ছাগলটাও থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝুপ করে চিতাটা লাফ দিল তাবুটার মধ্যে ঐ ছাগলের আওয়াজ লক্ষ্য করে। জালের দড়ি টানা হলাে। নীরুও তৎপরতার সঙ্গে তাবুর ঘোটা খুলে দিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনজনে মিলে একনাগারে বাঁশী বাজিয়ে চলেছে, বিকট আওয়াজ।' এই আওয়াজে এদেরই কানে তালা লেগে যাচ্ছে, তা ওই চিতার।

চিতাটা ক্রমশঃ লাফাচ্ছে ভেতরে। বাবুটা উঠছে, নামছে। আর তিনজনে মিলে ঐ তাবুর উপর ব্যাট দিয়ে পিঠে লাগছে। বাঘের কেবল লাফাচ্ছেই। তাবুর কাপড়টা মােটা তাই ব্যাটের আঘাত খুব একটা জোরে লাগছে না। তাই নীরু বললেতােমরা তৈরী হও, আমি তাবুটা তুলে ফেলছি। নীরু তাঁবুটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল চিতাটা জালে বেশ জড়িয়েছে। 


অজয় তার কাছে গিয়ে তার ব্যাটটা দিয়ে খোঁচা দিলে চিতাটা তার একটা থাবা অজয়ের হাতে মারলাে অজয়কে সাবধান হওয়ার সুযােগ না দিয়েই। অজয়ের হাতে ক্ষত না হলেও চিতার থাবার জোর যা তাতে আঘাতটা বেশ জোরেই হয়েছে। এতে চিতাটা বুঝেছে যে, সে বন্দী হয়েছে তার ওপর ব্যাটের ঘা কয়েকটা পড়েছে। সবার ওপর সে বলের আঘাত পেয়েছে এবং সেটা বেশ জোরেই।



বিজয় তার হাতের ব্যাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে লাগলাে। নীরুও

পাগলের মত তাকে ব্যাটের বারি মারতে লাগলাে। চিতাটাও ক্রমশঃ লাফাতে লাফাতে নিস্তেজ হয়ে পড়লাে। এইবার বিজয় দৌড়ে গিয়ে নাইলনের দড়ি নিয়ে এসে নীরুর সাহায্যে বেশ ভালভাবে বেঁধে ফেললে। অজয় বললে ওর মুখের মধ্যে একটা বল ঢুকিয়ে দে,

যাতে চিতাটা কামড়াতে না পারে। বিজয় সেই মত করলাে। এত সহজে যে

চিতাটাকে ওরা কজা করতে পারবে তা ভাবতেই পারলাে না।

কিভাবে চিতাটাকে রেখে বিজয়, অজয়ের হাতটা পরীক্ষা করে দেখলাম অজয় বললে চোটটা বেশ ভালই লেগেছে রে। আমার এভাবে অন্যমনস্ক হওয়া উচিত হয়নি। আমি ভেবেছি জালের মধ্যে রয়েছে তাে। অতএব ক্যাজুয়েলি ওর সামনে এগিয়েছি, যেটা মােটেই উচিত হয়নি।

নীরু বললে দাদারা তােমরা অপেক্ষা করাে। আমি লােকজন নিয়ে এক্ষুণি আসছি। নীরু ছুটে চলে গেল।

বিজয় অাকে কিছু চোটের ওষুধ খাইয়ে দিল। অজয়ের হাতের বর্মটা খুলে টেনে দেখতে গিয়ে অজয়ের আর্ত চিৎকারে বোঝা গেল চোটটা বেশ ভালই লেগেছে। একটা কাঠের ছােট্ট প্লেট নিয়ে হাতটা জোরে চেপে বেঁধে দিল।

ইতিমধ্যে নীরু লােকজন নিয়ে হাজির। সবাই হৈ হৈ করে চিৎকার করছে। নীরু সবাইকে চুপ করতে বলে চিতাটাকে দেখালাে। দেখা গেল বাঘের জালের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে আর খানিকটা নিস্তেজও বটে।

নীরুর লােকেরা জঙ্গল থেকেই বাঁশ কেটে নিয়ে এসে ঐ বাঁধা চিতাটাকে বাঁশ দিয়ে বেঁধে রাখলাে এমনভাবে যাতে কাধে করে সবাই মিলে নিয়ে যেতে

পারে।


শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 7


নীরু তার লােকেদের নিয়ে তাবু এবং অন্য সব জিনিষ গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হলাে। এমন সময় হঠাৎ ছাগল ডাকার আওয়াজ পাওয়া গেল। সবাই থতমত খেয়ে গেছে। কি ব্যাপার এখানে ছাগল আবার কোথা থেকে এলাে।

অজয়, বিজয়, নীরু হেসে উঠলাে। চিতাটা লাফালাফিতে টেপটা বন্ধ হয়ে

গিছলাে। আবার বাঁশ দিয়ে বাঁধার সময় টেপটা চালু হ'য়ে যায়। সেই টেপটা রয়েছে আবার চিতাটার ঘাড়ের কাছে। সেখান থেকে বার করতে হবে। নীরু বললো দাঁড়াও আমি বার করছি। একটা উইকেট নিয়ে ঘাড়ের তলায় দিয়ে ঘাড়টাকে একটু তুলে হাত দিয়ে বার করে আনলাে। চিতা ভায়ার আর নড়ার

ক্ষমতা নেই। তার সারা শরীর বাঁধা মুখের মধ্যে ডিউজ বল। সব গােছানাের পর চিতাটাকে কাধে তুলে সবাই হৈ হৈ করে চলেছেতাদের

শ্লোগান হচ্ছে"চলো-চলো, এগিয়ে চলাে-চিতাকে নিয়ে এগিয়ে চলো।”

Thursday, September 17, 2020

রাক্ষসপুরী

 রাক্ষসপুরী

ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়



নগর পারে রূপনগর। তা সেই রূপনগরের রাজার ছেলে রূপে গুণে কার্তিকেয়। কী চমৎকার যে দেখতে তা বলবার নয়। কথায় বলে রাজপুত্র। তা এই রাজপুত্র যেন সবার সেরা। 
রাজপুত্রের বয়স যখন ষোল, রাজামশাই তখন ঠিক করলেন এবার তিনি কোনও এক শুভদিনে রাজ্যভিষেক করে রাজপুত্রকে যুবরাজ পদে অভিসিক্ত করে রাজসভায় নিয়ে নেবেন। এবং পরে সুযােগ সুবিধা


মতাে সিংহাসনের পূর্ণ দায়িত্ব রাজকুমারের হাতে তুলে দিয়ে অবসর নেবেন তিনি। রাজার অন্তরের এই সুপ্ত বাসনাটা মেনে নিল সকলেই। নেবে নাই বা কেন? রাজার ছেলেই রাজা হবে এ তাে সবাই জানে। কিন্তু মেনে নিল না একজন। সে রাজপুত্র স্বয়ং। 

রাজপুত্র বলল,“মহারাজ! আপনি আমার পিতা। আপনার হুকুম অমান্য করবার মতাে সাহস আমার নাই। আমার রাজসিংহাসন চাই না এ কথাও আমি বলব না। আমার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। লেখাপড়া থেকে যুদ্ধবিদ্যার সবকটি ধাপ আমি পার হয়ে এসেছি। কিন্তু তবুও আমার একটা দিক অপূর্ণ আছে?” রাজামশাই বললেন, "কি রকম!"

আমি সব কিছুই জেনেছি। শুধু নিজের দেশটাকেই জানিনি। তাই এই পদে অভিষিক্ত হবার আগে প্রজাদের সুখ দুঃখ এবং রাজ্যের সীমা সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা করে নিতে চাই। অতএব আমি আমার রাজ্য ঘুরে দেখার জন্য আরও ছ'মাস সময় পাইনি।” রাজামশাই বললেন, এই কথা! সে ব্যবস্থা আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। ছ'মাস
রাক্ষসপুরী


কেন? একমাসে যাতে সে কাজ হয়ে যায় সে ব্যবস্থাও করে দেবাে আমি। তােমাকে নিয়ে যাবার জন্যে রথ এখুনি প্রস্তুত হবে। আমার পাঁচ হাজার সৈন্য তােমার সামনে পিছনে থাকবে। গদি বিছানা সমেত তাবু যাবে। বলেই হাঁক দিলেন, "মন্ত্রীমশাই!

আপনি এখুনি রাজকুমারের নিরাপত্তামূলক সবরকমের ব্যবস্থা করুন।” রাজকুমার বললেন,“উহু। ওইভাবে আমি যাবাে না তার কারণ আমি তাে প্রমােদ ভ্রমণে যাচ্ছি না। 

আমি যাচ্ছি নিজের দেশকে চিনতে জানতে। কাজেই আমি যাবাে ঘােড়ায় চেপে তরােয়াল হাতে বীরের মতাে। আর আমার সঙ্গে যাবে মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র এবং কোটালপুত্র। সেই সুযােগে তাদেরকেও আমি বাজিয়ে দেখতে চাই।

মহারাজের তাে মােটেই ইচ্ছা নয় রাজকুমারকে এইভাবে ছাড়তে। আর রাজপুত্রেরও জেদ এইভাবেই সে যাবে। রাজপুত্রের জেদ দেখে মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল কেউই না করল না তাদের ছেলেদের ছাড়তে।

অতএব কোনও এক শুভদিনে রাজারাণীকে প্রণাম করে রাজপুরী থেকে বিদায় নিলেন রাজপুত্র। সঙ্গে চলল মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্র। যাইহােক, তারা এ দেশ ও দেশ করে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের সীমা এবং প্রজাদের দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানল। কাদের কী অভাব, কিসের প্রয়ােজন, কী পেলে খুশি হয় সব


জেনে এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করল। সে কী নিবিড় গভীর বন। দিনের বেলাতেও সেখানে সূর্যের আলাে পৌঁছায় না। তা সেই বনের মধ্যে এক জায়গায় একটি নদী ও ঝবনা দেখে বিশ্রাম করতে বসল ওরা। তখন দুপুরবেলা। ক্ষুধায় ওরা কাতর সকলে। 
এমন সময় ওরা দেখল একদল ময়ূর ওদের সামনে এসে পেখম মেলে নাচছে। দেখে মন ভরে গেল ওদের। যাক।”

কোটালপুত্র বলল, “আপাতত একটা মযুর মেরে খাওয়া রাজপুত্র বলল, "না। দেখছ না ওরা কত সুন্দর। আমাদের দেখে আনন্দ হয়েছে ওদের, তাই এত নাচছে। ওদের কখন মারে?” তারপর এসে দাঁড়াল একদল হরিণ।

সেনাপতি বলল, তা হলে কি এই হরিণই একটা বধ করা যাবে? এই কথা শােনামাত্রই দেখা গেল একটা হরিণ এসে ওদের পায়ের সামনে গড়াগড়ি খেতে লাগল। অর্থাৎ আকারে ইঙ্গিতে সে বােঝাতে চাইল, হে কুমারগণ!

তােমরা আমাকে আহার করেই তৃপ্ত হও।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 1

রাজপুত্র বলল, হরিণের মাংস অতি সুস্বাদু। তবে কিনা যে আমাদের ভালবেসে এবং আমাদের ক্ষুধার কথা চিন্তা করে নিজের থেকে তার দেহ দান

করতে আসছে তাকে কখনও বধ করা উচিত নয়।” রাজপুত্রের এই কথা শােনামাত্রই সেই বনে যত পশুপক্ষী ছিল সবাই একসঙ্গে তাদের নিজের নিজের ভাষায় কেউ ডেকে কেউ শিস দিয়ে জয়ধ্বনি করল। আবার ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল একদল হনুমান কী যেন সব বয়ে নিয়ে আসছে।

হনুমানগুলাে যা নিয়ে এল তা হল এই। কেউ নিয়ে এল পাকা কলা, কেউ গাছপাকা পেঁপে, কেউ বা আম, জাম। কেউ পেয়ারা। তাছাড়া আরও কত কী সুস্বাণু

ফল।

রাজপুত্র তাে খুব খুশি। বন্ধুদের নিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সেই সব খেতে লাগল। তারপর যা হল তা আবার আরও মজার। ওরা করল কি কোথা থেকে যেন কচি ঘাস ছিড়ে এনে গাছতলায় বিছিয়ে বেশ পুরু গদীর মতাে করে বিছানা করে দিল। তারপর আকারে ইঙ্গিতে ওদের শুতে বলে শুরু করল ওদের গা হাত পা টেপা। শুধু তাই নয়, বনের পশুপাখি সবাই মিলে সারারাত জেগে ওদের ঘিরে পাহারা দিতে লাগল।



রাজপুত্র বলল,“বনের পশু। এদের আমরা বন্য প্রাণী বলেই জানতাম। কিন্তু এদের বুকেও যে এত বাৎসল্য, স্নেহ, মমতা আছে তা তো জানতাম না। সেইজন্যেই যেখানে বনের ফলমূলের রসাস্বাদন করে আমাদের পেট ভরে সেখানে অযথা আমরা এইসব প্রাণীগুলােকে মেরে খাই। যাই হােক, আমি যখন রাজা হবাে তখন এ দেশ থেকে প্রাণী হত্যা একদম বন্ধ করে দেবাে। আর বলে দেবাে এই বন থেকে একমাত্র

শুকনাে গাছ ছাড়া অন্য কোনও গাছের একটা ডালও কেউ যেন না কাটে।” তাই না শুনে হনুমানগুলাের উপ আপ করে সে কী লাফানি। কতকগুলাে বাঁদরও আবার জুটে গেল তাদের সঙ্গে। তারা মু মু করে কী সব বলতে

লাগল। যাই হােক, বনের পশুরা সেবা-যত্নের কথা বলতে বলতেই রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্র গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। সেই ঘুম যখন ভাঙল তখন সােনার বরণ তরুণ তপন অরুনরাগে ভুবন যেন ভরিয়ে দিয়েছে। 

সােনা রােদের ছটা লেগে গাছের পাতা চিক চিক করছে। নদীর বালি চিকচিক করছে। ঝরনার জলে রামধনু হচ্ছে। যাই হােক, রাজপুত্র সকলকে নিয়ে নদীর জলে মুখ হাত ধুয়ে ফলটল খেয়ে ঘােড়ায় চেপে বসল। কিন্তু মুশকিল হল নদী পার হতে গিয়ে। যেই না ওরা নদীতে নামল অমনি চিৎকার করে উঠল সকলে। সেইসঙ্গে কি লাফালাফি।

ব্যাপারটা যে কী তা ওরা কেউই কিছু বুঝতে পারল না। ভাবল ওরা চলে যাচ্ছে তাই বিদায় দিতে কষ্ট হচ্ছে বলেই বুঝি ওইরকম করছে ওরা। হনুমানগুলাে তাে ওদের পা ধরে ঝুলে পড়ল। 

কিন্তু তবুও ওরা বুঝতে পারল না ওদের কথা। জোর কদমে ঘােড়া ছুটিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাল সকলকে। অভিবাদন তাে জানাল। কিন্তু কী দেখল? দেখল হরিণের চোখে জল। ময়ূর

কাদছে। বাঁদর হনুমানের দল বুক চাপড়াচ্ছে। পাখিরা কলরব করে মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, নদীর এপারে কেউ আসছে না। মন্ত্রীপুত্র বলল, ব্যাপারটা কী বল দেখি? নিশ্চয়ই ওরা আমাদের এইদিকে

আসতে মানা করছে।”

রাজপুত্র বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।” সেনাপতি বলল, “এই হিতৈষিদের আবেদন শুনে আমাদের কিন্তু ফিরে

যাওয়া উচিত।” কোটালপুত্র বলল, "আমিও তাই মনে করি।”




রাজপুত্র বলল, “হ্যা আমিও এ ব্যাপারে একমত। তবে কিনা ফিরে আমরা

যাব না, দেখব এর আসল রহস্য কোনখানে। ওদের ভয়ের ব্যাপার যদি এখানে কিছু থাকে তবে তা আমরা নির্মূল করব।” বলেই ওরা রহস্যাভিযানের জন্য ছুটিয়ে দিল ঘােড়াগুলাে। নদীর ওপারে ছিল মরুভূমি। তাই ঘোড়া ছুটছে তাকে ছুটছেই। তবে মরুভূমি বলতে একেবারে ধু ধু বালুর মরুভূমি নয়। কোথাও বালি মাটি, কোথাও বা শক্ত পাথর।

 যাই হােক, অনেকদূর যাবার পর সে মরুভূমির বুকে ওরা একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখতে পেল। কিন্তু সেই প্রাসাদ বড়ই রহস্যময়। সেখানে না আছে লােকজন না আছে কিছু। শুধুই প্রাসাদ। আরও মজার ব্যাপার এই যে সেই প্রাসাদে প্রবেশ করবার মতাে দরজা কোথাও নেই।


 চারিদিকেই বৃত্তাকার পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাজপুত্র বলল, “বেশ মজার ব্যাপার দেখছি। এই প্রাসাদে যারা থাকে তারা বেরােয় কোথা দিয়ে! আর ঢােকেই বা কী করে?” কোটালপুত্র বলল “দাঁড়াও, এর রহস্য আমি বের করছি।” বলেই সেই

পাঁচিলের কাছে ঘােড়া নিয়ে গিয়ে তার পিঠে পাঁচিলের ওপর উঠল। উঠেই ভেতর

দিকে তাকিয়ে হাে হাে করে হেসে লাফিয়ে পড়ল ভেতরে। কিন্তু সেই যে লাফাল আর উঠল না। এরা তাদের বাইরে থেকে অনেক চেঁচামেচি করল। ডাকাডাকি করল। কিন্তু

কোনও সাড়া নেই শব্দ নেই। অবশেষে সেনাপতিপুত্র বলল, "দাঁড়াও এবার আমি উঠে দেখি ব্যাপারটা কী

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 2

মন্ত্রীপুত্র বলল, "সোনা ভাই, তুমি কিন্তু ওর মতাে কোরাে না। যা দেখবে

তা আগে বলবে। তারপরে ওর খোঁজ করাে। কেমন?

সেনাপতিপুত্র বলল, “সে কথা আবার বলতে।” বলেই ঘোড়ার পিঠে পা দিয়ে পাঁচিলে উঠল। উঠেই ভেতর দিকে তাকিয়ে হা হাে করে হেসে লাফিয়ে পড়ল ভেতরে।

রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মন্ত্রীপুত্র বলল, এটা নিশ্চয়ই কোনও মায়াপুরী। আর তারই প্রভাবে ওরা এইরকম করল। আমাদের মনে হয় আর এই বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

চলাে আমরা ফিরে যাই।”

রাজপুত্র বলল, 'তা হয় না ভাই। ফিরলে আমরা চারজনেই ফিরব। না হলে



কেউ নয়। এবারে দেখার পালা তোমার। মন্ত্রীপুত্র বলল, “তাই হােক তবে। এবার তা হলে আমিই দেখি। এই বলে মন্ত্রীপুত্রও ঘােড়ার পিঠে পা দিয়ে পাঁচিলে উঠল এবং ওই একইরকমভাবে ভেতরে লাফিয়ে পড়ল।

রাজপুত্র আর বাকি থাকে কেন? সেও পাঁচিলে উঠল। বলা বাহুল্য তার বেলাতেও এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হল না। ওরা চারজনেই প্রাসাদের ভেতরে উঠানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখন

সবাই সবাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ক্রমে দিন গেল। সন্ধ্যে হল। আর ঠিক সেই সময় ওরা দেখতে পেল ভয়ঙ্কর রাক্ষসী আকাশপথে উড়ে এসে ও দের সামনে দাঁড়াল।


 কী বিশাল চেহারা। রাক্ষসী ওদের দেখে হাে হাে করে হেসে উঠে এক হাতের মুঠোয় চারজনকে নিয়ে একটা বড় হল ঘরে এল। সেই ঘরের এক কোণে একটা বড় উনুনে প্রকাণ্ড একটি তেলভর্তি কড়া বসানাে আছে। আর তার চারিদিকে ছড়ানাে আছে অসংখ্য হাড় গােড় ইত্যাদি।

রাক্ষসী ওদের চারজনকে সেই ঘরের মেঝেয় চিৎ করে শুইয়ে হাতে পায়ে গজাল মেরে মাটির সঙ্গে গেঁথে রাখল। তারপর বিকট হাসি হেসে বলল, আমি বহুদিন ধরে একটু সুস্বাদু মাংস খাবার চেষ্টা করছিলুম। বাঁদর, হনুমান, গরু, ছাগল খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। 


এইবার তােদের খেয়ে আশ মেটাবাে। আগে কাল সকালে তােদের ঘােড়াগুলােকে ভেজে খাবাে। তারপর এক একদিন তােদের এক একজনকে খেয়ে অরুচি কাটাব। এখন শুয়ে তােরা মরণের প্রতীক্ষা কর।” এই বলে চলে গেল রাক্ষসী।

রাক্ষসী চলে গেল তাে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল সকলে। কাঁদবে নাই বা কেন, এ জীবনের মতাে ঘরে ফেরার আশা, বাবা মাকে দেখবার আশা সবই তাে দুরাশা হয়ে গেল। তাই কাদতে লাগল। কিন্তু কথায় বলে না অরণ্যে রােদন, তা ওদের কান্না শুনবে কে?

মন্ত্রীপুত্র বলল, “ভাইরে, এইখানে এইরকম বিপদ ঘটতে পারে জেনেই বনের পশুপক্ষীরা অত বাধা দিয়েছিল আমাদের। যেমন আমরা মানিনি তাদের বাধা, তেমনই এখন হাতেনাতে তার ফল আমাদের ভােগ করতেই হবে। যাই হােক, এইভাবে রাত্রি তাে প্রভাত হল।

সকালবেলা রাক্ষসী এসে বিকট মূর্তি ধরে আগে খানিকটা হাসল। তারপর



বলল, "কী বাছাধনরা। কেমন লাগছে? এইবার আমার খেলা দেখাে?" বলেই সেই তেলের কড়ায় জাল দিয়ে একটা করে ঘােড়া এনে গরম তেলে মুচমুচে করে ভেজে খেয়ে ফেলল। সে দৃশ্য সত্যিই দেখা যায় না। অত সাধের ঘােড়া ওদের। কত দেশ দেশান্তর

ঘুরিয়ে নিয়ে এল। অথচ কী তাদের পরিণতি। রাক্ষসী ঘােড়াগুলােকে খেয়ে বলল, আঃ বাঁচলাম। কতদিন যে ঘােড়ার মাংস খাইনি। এবার কাল থেকে শুরু করব এক একদিন তােদের এক একজনকে খাওয়া। কাল কার পালা হবে তােরাই ঠিক করে রাখ। এখন আমি চরতে যাচ্ছি।”

এই বলে শন শন করে উড়ে চলে গেল রাক্ষসী।

সেই দিন রাত যে কীভাবে কাটল তা ওরাই জানে। কাল সকালে যে কার পালা সেই কথা ভাবতে ভাবতে রাত কাবার হয়ে গেল। ঘুম এল না কারও চোখেই। পরদিন সকালে যথারীতি রাক্ষসী এল। এসেই বলল, “কি রে, কিছু ঠিক

করলি কাকে খাবাে আজ? রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতি পুত্র, কোটালপুত্র সবাই একসঙ্গে বলল, "আমাকে আগে খাও।”

তাই না শুনে রাক্ষসী বলল, যাঃ বাবা! তােরা ভয়ে কাদবি কোথায়, প্রাণ ভিক্ষা চাইবি তার জায়গায় মরবার জন্য ছটফট করছিস? তা ঠিক আছে, আমিই আমার খাবার বেছে নিচ্ছি।” বলেই কোটলপুত্রকে হেঁচকা টানে গজল শুদ্ধ উপড়ে এনে তেলের কড়ায় ফেলে দিল। তারপর বেশ মড়মড়ে করে ভেজে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, কাল সাকালে আবার আসব। খাবাে তােদের একজনকে।

কোটালপুত্রের পর স্বাভাবিক ভাবেই পালা আসে সেনাপতিপুত্রের। তাই আগামীকাল সেনাপতিপুত্রকে তেলের কড়ায় মড়মড়ে করে খেয়ে রাক্ষসী চলে গেল।

দিন গেল। রাত এল।

শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 3


কাল সকালে মন্ত্রীপুত্রের পালা।

রাজপুত্র বলল, ভাইরে কোনওরকমে কি এই ভয়ঙ্করীর গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না?" মন্ত্রীপুত্র বলল, “আমিও তাে সেই কথাই ভাবছি ভাই রাজকুমার। আমি



মরব। কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে যদি তােমার জীবন আমি রক্ষা করতে না পারি তা হলে বৃথাই এ জীবন।”

রাজপুত্র বলল, “তুমি তাে অনেক বুদ্ধি রাখাে ভাই। দেখাে না একটু মাথা খাটিয়ে কোনও উপায় কিছু বার করতে পারবে না।" মন্ত্রীপুত্র বলল, বেশ। আমাকে একটু তা হলে ভেবে দেখার সময় দাও।”

মন্ত্রীপুত্র অনেকক্ষণ ধরে ভেবেচিন্তে একসময়ে বলল, একটাই উপায় আমার

মাথায় এসেছে। সেই উপায়টা কাজে লাগাতে পারলে হয়তাে আমরা বাঁচতে পারি। রাজপুত্র আশান্বিত হয়ে বলল, “কি উপায়! কি উপায়!” “তাতে কিন্তু কষ্ট খুব। আর বিপদের ঝুঁকিও অনেক।

"বিপদের আর বাকিটা কী আছে? কাল সকালে হয় তুমি না হয় আমি দুজনের

মধ্যে যে কেউ রাক্ষসীর পেটে যাবাে। পরশুর মধ্যে দুজনেরই পালা শেষ।” তাহলে এসাে আমরা বাঁচার চেষ্টা করি।” বলেই মন্ত্রীপুত্র গায়ের জোরে হেঁচকা টান দিয়ে একটা হাত কে গজালমুক্ত করল। হাতের তালুর মাঝখানটা গর্ত

হয়ে গেল তাতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। একটা হাত হতেই আর একটা হাত।

তারপর দুটো পা।

মন্ত্রীপুত্র নিজে মুক্ত হয়েই রাজপুত্রকে টেনে হিচড়ে গজল মুক্ত করল। তারপর সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্রের ছিন্ন পরিত্যক্ত পােশাক ছিড়ে হাতে পায়ে ব্যাণ্ডেজ করে পা টিপে টিপে ওপরে এল। ওপরে উঠেই দেখল রাক্ষসীটা দরজা আগলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। 


সে কী নাক ডাকার শব্দ তার। ওরা কোনরকমে পা টিপে টিপে শুয়ে রাক্ষসীটার পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে এল। তারপর বারান্দার কাছে এসে রেলিঙে একটা দড়ি বেঁধে টুপটাপ করে নেমে পড়ল সেই পাঁচিলে। আর তারপরেই ধুপ ধাপ করে লাফিয়ে নামল বালিতে। 

নেমেই ছুট-ছুট ছুট। ঘােড়ার খুরের দাগ লক্ষ করে প্রাণপণে ছুটতে লাগল দুজনে। তবে কিনা একে, তাে বালির ওপর দিয়ে ছােটা যায় না তার উপর কাটা ছেড়া পা নিয়ে ছােটা। তাই দারুণ কষ্ট হল ছুটতে।

ছুটতে ছুটতে ভাের হয়ে এল। তারপর সকাল। যেই না সকাল হল অমনি পুব দরজা দিয়ে সূর্যের আলাে এসে রাক্ষসীর মুখের ওপর পড়ল। এইভাবেই রােজ ওর ঘুম ভাঙে। আজও ভাঙল। রাক্ষসী তাে আড়মােড়া ভেঙে নিচে এসেই দেখল পাখি ফুডুত। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দেখল রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র অনেক-অনেক দূরে চলে



গেছে। অমনি সে বন বন করে শন শন করে বিকট হাঁক ডাক পেড়ে উড়ে চলল ওদের ধরার জন্যে।

রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র তখন নদীর কাছাকাছি। যেই না ওরা নদীর কাছাকাছি এসেছে অমনি বনের সেই পশুপক্ষীদের সে কী আনন্দ উল্লাস। বাঁদর হনুমানের দল তাদের লম্পঝম্প করে হাত নেড়ে উ আপ

কিচ কিচ করে ডাকতে লাগল ওদের। মন্ত্রীপুত্র ওদের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে

রাজপুত্রকে বলল, “শিগগির চলাে ভাই। মনে হচ্ছে এই নদীটাই রাক্ষস রাজ্যের সীমানা। এইজন্যই বাঁদর হনুমানের দল আমাদের নদী পার হতে বলছে।” রাজপুত্র বলল, “হ্যা। তা বেশ ভালােই বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া পিছনে ওই দেখাে রাক্ষসী কেমন ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে। ওরা দুজনে ছুটে এসে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ল।

আর অমনি সেই বাঁদর হনুমানের দল ছুটে এসে হাত ধরে ডাঙায় তুলল

ওদিকে রাক্ষসী টা তখন উড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়েছে নদীর ওপারে বালুচরে।

ওদের।

রাগে থরথর করে কাপছে তখন রাক্ষসী। ভীষণ চিৎকার করে রাক্ষসী বলল,

যাঃ। খুব জোর বেঁচে গেলি এ যাত্রা। এই প্রথম আমার শিকার আমার গ্রাস থেকে

পালিয়ে বাঁচল।তবে তােদের জন্যে প্রতীক্ষা করব আমি। আবার একদিন না একদিন

পথ ভুলে এদিকে আসতে হবে তােদের। নেহাত এই নদী পার হবার অধিকার নেই

আমার তাই। নাহলে তােদের চিবিয়ে খেলাম। বলে গর্জন করতে করতে চলে

গেল। আর ক্লান্ত রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র একটি গাছতলায় শুয়ে হাঁফাতে লাগল। বাঁদর হনুমানের দল খুব সেবাযত্ন করতে লাগল ওদের। কলাগাছের পাতা মুড়ে বটের পাতায় খিলি করে হরিণের দুধ এনে খাওয়া। ফলমূল খাওয়াল। 


শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4

আর এক বৃদ্ধ হনুমান করল কী বনের ভেতর থেকে কী সব লতাগুল্ম এনে সেগুলাে দাঁতে চিবিয়ে ওদের যথাস্থানে লাগিয়ে দিল। অব্যর্থ ওষুধ। রাতারাতি সব ঠিক হয়ে গেল। ব্যাথা বেদনা দূর হল। এমনকি হাত-পাণ্ডে দেখে মনে হল যেন ওখানে

কোনও দিন কিছুই হয়নি। যাই হােক, দিন দুই বিশ্রাম নেবাল পরই রাজপুত্র ও মন্ত্রিুত্র চাঙ্গা হয়ে উঠল





অনেকটা। শরীরে আবার আগের মতাে বল ফিরে পেল। তাই ওরা বাড়ি ফেরার জন্য পথ হারিয়ে সেই বনের আরও গভীরে ঢুকল।

তৃতীয় দিন রাত্রিবেলা গভীর বনে রাজপুত্র যখন একটি গাছের ডালে বসে ঘুমাচ্ছে তখন হঠাৎ ফোস ফোঁস শব্দে রাজপুত্রের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই রাজপুত্র দেখল একটা অজগর সাপ আস্ত হরিণকে ধরে গিলে খাচ্ছে আর সেই বন কিসের আলােয় যেন আলােকিত হয়ে আছে।

রাজপুত্র চুপিচুপি মন্ত্রীপুত্রকে ডেকে সেই দৃশ্যটা দেখাল। মন্ত্রীপুত্রও অবাক। ওয়া দুজনে দেখল হরিণটাকে গিলে খেয়ে অজগর আবার ফোস ফোঁস করতে করতে সেই গাছের কাছে এল। তারপর গাছতলা থেকে একটি চকচকে জিনিস মাথায় নিয়ে বড় একটি গর্তের ভেতরে ঢুকে গেল। আর যেই না যাওয়া আবার

সেই ঘাের অন্ধকার।

সে রাতে আর ঘুম হল না কারও, নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে জেগেই কাটাল দুজনে।

মন্ত্রীপুত্র বলল। "অজগর যেটা মাথার উপর করে নিয়ে গেল সেটা কী তা

জান?

রাজপুত্র বলল, দেখিনি কখনও। তবে বুঝতে পেরেছি। সাত রাজা ধন এক মানিক।”

“হ্যাঁ, এখন থেকে ওই মণিটি লাভ করার জন্যে আমাদের খুব সজাগ এবং তৎপর থাকতে হবে। কাল রাতে অজগর যদি আবার শিকার ধরতে আসে তা হলে। ওই মণিটা আমরা উদ্ধার করব।”

এই কথামতাে পরদিন সকাল হতেই মন্ত্রীপুত্র করল কী খুঁজে পেতে এক জায়গা থেকে খানিকটা গােবর কুড়িয়ে এনে গাছতলায় রেখে দিল। তারপর রাত্রিবেলা

গাছের ডালে চুপচাপ বসে রইল দুজনে।

মাঝরাতে মণি মাথায় নিয়ে অজগর আবার সেই গর্ত থেকে বেরুলাে। তারপর গাছতলায় মণিটি রেখে যেই না শিকার ধরতে চলে গেল অমনি মন্ত্রীপুত্র করল কী সেই গােবরটা এনে চাপা দিয়ে দিল মণিতে। গােবর ঢাকা দিতে আর কোনও আলােই

বেরলাে না তখন। এদিকে অজগর শিকার করে বন বিচরণ করে ফিরে এসে তার মণি দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে মাথা খুঁড়ে মরে গেল।


সাপটা মরে গেলেও ওরা নামল না। নামল ঠিক পরদিন সকালে রােদ উঠলে। রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র ল কি সেই গােবরমাখানাে মণি নিয়ে সেটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করবে বলে জলের সন্ধানে এগিয়ে চলল, খানিকদূর যাবার পর ওরা দেখল একটা

সমুদ্র অনন্ত জলরাশি নিয়ে ঢেউ সমেত তীরে এসে আছড়ে পড়ছে।

তা মন্ত্রীপুত্রকে বসিয়ে রেখে রাজপুত্র গেল মণিটা ধুতে। কিন্তু অবাক কাণ্ড।

রাজপুত্র যত এগােয় সমুদ্র ততই দু’ভাগ হয়ে গিয়ে রাজপুত্রকে পথ করে দেয়। খানিক যাবার পরেই রাজপুত্র সমুদ্রের নিচে একটা সিঁড়ি দেখতে পায়। সেই সিঁড়ি বিয়ে সবে কয়েকধাপ নেমেছে অমনি আবার জলে ঢেকে গেল সব।

মন্ত্রীপুত্র তাে অনেক ডাকাডাকি করতে লাগল তীরে বসে। সে বারবার চিৎকার

করে বলতে লাগল “রাজকুমার ফিরে এসাে। ফিরে এসাে রাজকুমার! দরকার নেই

পাতালপুরীতে যাবার।”

কিন্তু কে শােনে কার কথা? সমুদ্রের ভয়ঙ্কর গর্জনে সব কিছুই চাপা পড়ে গেল। মন্ত্রীপুত্র তখন বাধ্য হয়ে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে রাজ্যে ফিরে এসে কাদতে কাদতে সব বলল - হারাজকে।

রাজপুরীময় শোকের ছায়া নেমে এল। এদিকে হল কী, রাজপুত্র পাতালপুরীতে প্রবেশ করেই দেখল অবাক কাণ্ড। সে এক বিশাল পুরী। কিন্তু পুরীতে কোনও লােকজন নেই। থরে থরে খাবার সাজানাে আছে, কিন্তু দোকানি নেই। ফুলের বাগান আছে, মালি নেই। 

রাজপুত্র বুঝল আবার সে নতুন করে মায়াপুরীতে এসে পৌছেছে। যাই হােক, তবুও রাজপুত্র তাে পালাতে জানে না। তাই একটা দোকানে বসে বেশটি করে পেট পুরে খাবারদাবার খেয়ে রাজপুরীতে ঢুকল। এ ঘর ও ঘর করে হঠাৎ একটি ঘরে ঢুকেই চমকে উঠল সে।

 যা সে চোখে দেখল তাতে নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারল না। এ কী দেখছে সে। একই অঙ্গে এত রূপ। এও কখনও সম্ভব! সে দেখল এক অপরূপ রূপ লাবণ্যবর্তী রাজকন্যা সোনার খাটে শুয়ে পরম শান্তিতে ঘুমােচ্ছে। সেই রাজকন্যার মাথার কাছে আছে একটা সোনার কাঠি আর একটি রূপার কাঠি। রাজপুত্র অনেক চেষ্টা করল রাজকন্যার ঘুম ভাঙাবার। 

কিন্তু শত ডাকেও সে ঘুম ভাঙল না। যখন কিছুতেই কিছু হল না তখন সােনার কাঠিটা ছোঁয়াতেই অবাক কাণ্ড! রাজকন্যা চোখ মেলে তাকাল। তাকিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল, “কে! কে তুমি?” রাজপুত্র নিজের পরিচয় দিল।


শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 5


রাজকন্যা বলল, তুমি এখানে কী করে এলে?"

রাজপুত্র সে কথাও খুলে বলল রাজকন্যাকে। রাজকন্যা বলল, "তোমার নাম?" "আমার নাম দুধকুমার। তােমার নাম?”

“আমার নাম চম্পাবতী।” "তুমি কত সুন্দর।

“তুমিও;

“আমি তােমাকে বিয়ে করতে চাই।”

আমিও।"

আনন্দে দুজনে দুজনের হাত ধরল।

রাজপুত্র বলল, কিন্তু তুমি এইখানে এইভাবে শুয়ে আছে,একা একা তােমার

ভয় করে না?”

রাজকন্যা বলল, “আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

আমি তােমাকে এখুনি এখান থেকে নিয়ে পালাবো।”

পারবে না।

“কেন পারব না চম্পাবতী?”

তা হলে শােন, আমি চম্পানগরের রাজকন্যা। আমার মা, বাবা, এবং রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের চিবিয়ে খেয়ে এক রাক্ষসী আমাকে এই পাতালপুরীতে এনে লুকিয়ে রেখেছে। আর আমাদের সেই চম্পানগরকে করে রেখেছে এক বিশাল মরুভূমি। এই রাক্ষসীরা দুই বােন।

ছােট বোনকে সেইখানে রেখে নিজে এই পাতালপুরীতে বাস করেছে। কেন জানিনা রাক্ষসীরা আমাকে ভালবেসে ফেলেছে খুব। তাই আমাকে ওরা মারেনি। সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। ওই রূপার কাঠি আমার গায়ে ছোঁয়ালেই আমি ঘুমিয়ে পড়ব। আবার সোনার কাঠির ছোঁয়া পেলে জেগে উঠব।”

আমি যদি ওই রাক্ষসীকে বধ করি?” ওরা অমর। ওদের নজর এড়িয়ে আমরা যেখানেই যাই না কেন ওরা

আমাদের ধরে ফেলবে।

“এদের কোনও সীমানার গণ্ডি দেওয়া নেই? “আছে। এই সমুদ্রটাই ওদের গণ্ডি। ওদের নজর এড়িয়ে সমুদ্র পার হতে



গেলেই ওরা জানতে পারবে। আর তখনই ধরে খেয়ে ফেলবে দুজনকে।

"তা হলে উপায়?”

“উপায় একটাই। তুমি আমাকে ছেড়ে এখান থেকে যেও না, রাক্ষসী রােজ

সকালে আমাকে রূপাের কাঠিতে ঘুম পাড়িয়ে চলে গেলে তুমি আমাকে জাগিয়ে তুলাে। আর সন্ধে হবার আগেই একটা গােপন জায়গায় লুকিয়ে থেকো।

রাজপুত্র বলল, "সেই ভালাে! এখন তো সবে দুপুর। রাক্ষসীর আসতে

অনেক দেরি। চলাে, তুমি আমাকে তােমাদের এখানকার সব কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে।”

“দিচ্ছি। তবে আজ কিন্তু রাক্ষসী তাড়াতাড়ি আসবে।

"কি করে জানলে? কিছু বলে গেছে বুঝি?”

“হ্যা। আসলে ও যখন রােজ চলে যায় তখন আমি ওকে জিজ্ঞেস করি কখন ফিরবে? তা ও যদি বলে তাড়াতাড়ি ফিরব তাহলে জানতে হবে সন্ধের আগেই

ফিরে আসবে।” যাইহােক, রাজপুত্র তাে রাজকন্যা পেয়ে খুশি। রাজকন্যাও রাজপুত্রকে পেয়ে খুব খুশি। এই পুরীর শেষ প্রান্তে পম্পা সরােবর নামে একটি সরােবর আছে। 

তার পাশেই আছে একটি শিবমন্দির। রাজপুত্র রাজকন্যার নির্দেশমতাে সেই শিবমন্দিরে লুকিয়ে থাকে। সারা রাত লুকিয়ে থাকে আর সকালে রােদ উঠলেই রাজকন্যার

কাছে গিয়ে হাজির হয়। এইভাবেই দিনের পর দিন যায়।

রাজপুত্র তার দেশ ভুলে গেল। বাপ মা ভুলে গেল। আর রাজারাণীও মাঝে মাঝে আসেন সমুদ্রতীরে। বসে হা হুতাশ করে মনের দুঃখ মনে নিয়ে ফিরে যান। এই করতে করতে রাজপুত্রের আশা এক সময় মন থেকে মুছেই ফেলেন তারা।

এদিকে রাজকন্যা রাজপুত্রকে পেয়ে খুশি হলেও তার বাবা মা ঘরবাড়ির খোঁজ নেয়। নিতে নিতে একদিন বলে, “চলে যা আছে কপালে একবার পালিয়ে


শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 6

যাবার চেষ্টা করেই দেখি কী হয়। রাজপুত্র বলে, “খবরদার ও কাজ করতে যেও না। তার চেয়ে চলাে এই শিবমন্দিরে আমরা দুজনে মালা বদল করে বিয়ে করে নিই। আর তুমি নানান কৌশলে রাক্ষসীর কাছে থেকে জেনে নাও ওদের মরণের জাদুটা কী?”


রাজপুত্রের কথামতাে তাই হল। বাগানের চাপা ফুলের মালা গেথে শিবমন্দিরে মালা বদল করে একদিন রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল। তারপর একদিন সম্ধ্যেবেলা রাক্ষসী ফিরে এসে যখন শুয়েছে রাজকন্যা তখন তার পা টিপতে বসে গেল।

রাক্ষসী অবাক হয়ে বলল, "কী রে, কী হল! আজ হঠাৎ আমার ওপর এত দরদ কেন তাদের ?”

রাজকন্যা করল কী একটা বাটিতে নুনু জল নিয়ে বসেছিল। সেই জল দু'এক

ফোটা রাক্ষসীর পায়ে ফেল দিল। আর রাক্ষসী আঙুলে করে সেই জল একটু চেখে

দেখেই বলল, ওমা! তুই কাদছিস ? আমি এত সুখে রেখেছি তাতেও তাের কান্না?" সে বলে, সুখে রেখেছ। কিন্তু একদিন যদি মরে যাও আমাকে দেখবে কে? রাক্ষসী হা হা করে হেসে বলল, ওরে পাগলি। আমি হলাম রাক্ষসী! আমার কি মরণ আছে? আমি আর আমার বোন দুজনেই আমার?”

"বাঃ, তাই আবার হয় নাকি? অমন রাবণরাজাও মরে গেল আর তােমরা

তাে কোন ছার।” রাক্ষসী বলল, তবে শােন, আমরা মায়ের মুখে শুনেছিলাম রাবণ রাজা নাকি আমাদের মাসতুতাে দাদা। তা তারও মরণ হতাে না। যদি না তার মৃত্যুবাণ চুরি

যেত।

তা হলে আমার কোনও ভয় নেই তো?"

“কিসের ভয়? আমরা রাক্ষসী। আমাদের প্রাণ অন্য জায়গায় রাখা থাকে।”

তাই নাকি? তােমাদের প্রাণ কোথায় থাকে?” রাক্ষসী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সে কথা কাউকে বলতে নেই রে।

তবে তুই তাে আমার মেয়ের মতন। তােকে বলতে কোনও আপত্তি নেই, তাই বলছি। ওই যে আমাদের শিবমন্দিরটা। ওর পাশে তে পম্পা সরােবর। তা ওই

পম্পা সরােবরের জলে কেউ যদি এক ডুবে নীচে যায় তা হলে একটা সােনার কৌটো দেখতে পাবে। সেই কৌটোর ভেতরে একটা কালাে ভ্রমর আছে। 

সেটাই হচ্ছে আমাদের প্রাণ। যদি কেউ ওই ভ্রমরটাকে এক কোপে কাটতে পারে তা হলেই আমরা মরে যাবাে। তা কাজ আর করবে কে? এই পাতালপুরীতে কেউ আসতেই পারবে না। ও কাজও করতে পারবে না। অতএব আমাদের মরণ হবে না।


রাজন্যা খুব খুশি হবার ভান দেখিয়ে বলল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। আমার যে কী ভয় হত।”

পরদিন সকালে রাক্ষসী চলে গেলে রাজপুত্র এল, তারপর সোনার কাঠির পরশে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে সব শুনেই লাফিয়ে উঠল সে বলল, এই কথা! আমি আজই ওদের শেষ করব। বলেই দেওয়ালে ঝােলান একটা তরােয়াল নিয়ে রাজকন্যা সহ চলল পম্পা সরােবরের দিকে। সরােবরের কাছে গিয়ে তরােয়াল উচিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল সরােবরের বুকে। 

তারপর এক ডুবে নীচে গিয়েই পেয়ে গেল সােনার কৌটোটা। সােনার কৌটোর মধ্যে সত্যিই একটা ভ্রমর ছিল। রাজপুত্র যেই সেই ভ্রমরটাকে এক হাতে ঠিপে ধরছে অমনি তাে রাক্ষসীরা টের পেয়ে গেল সব। তারা দুইবােন তাদের মৃত্যু আসন্ন জেনে ভীষণ চিৎকার করতে করতে ছুটে এল সরােবরের কাছে।


 কিন্তু এলে কি হবে? রাজপুত্র তখন এক কোপে ড্যাং করে দিয়েছে ভ্ৰমরটাকে। আর যেই না দেওয়া, রাক্ষসীরাও ড্যাং হয়ে গেল অমনি। দেখা গেল তারা দুই আধখানা হয়ে মরে পড়ে আছে। রাজপুত্র আর রাজকন্যার তখন সে কী আনন্দ। সেই মণির প্রভাবে তারা

আবার জল পার হয়ে ডাঙায় এল। পাতালপুরীর ধনরত্ন নিয়ে রাজ্যে ফিরে তা লাগিয়ে দিল সকলকে। রূপনগরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রাজারাণী আবার ঘটা করে রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিলেন। তারপর এক শুভদিনে রাজসিংহাসনে বসল। 

মন্ত্রীপুত্রও অভিষিক্ত হল নতুন মন্ত্রীপদে। শুধু কোটালপুত্র ও সেনাপতি পুত্রদের জন্য একটু যা দুঃখ রয়ে গেল সকলের মনে।

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...