Saturday, September 12, 2020

রাজকন্যা কঙ্কাবতী

 রাজকন্যা কঙ্কাবতী


বন্দে আলি মিয়া


এ ক ছিল রাখাল। তার মা ছেলে ভাই-বোন—না কোনাে আপনার জন। তিন কূলে তার কেউই ছিলাে না। একটি মাত্র গাভী আর সে। গাভীটিকে নিয়ে রােজ ভােরবেলায় সে মাঠে যেতাে। গাভীটি সারাদিন মাঠের চারিদিকে ঘুরে ফিরে ঘাস খেতা রাখাল গাছের ছায়ায় বসে একমনে বাঁশী বাজাতাে। সন্ধ্যোবেলায় তাকে নিয়ে সে ঘরে ফিরতাে।

একদিন রাখাল দেখতে পেলাে, মাঠের কোথাও গাভীটি নেই। মনটা তার ব্যাকুল হয়ে উঠলো।সন্ধ্যে হয়ে গেছে আবার তাকে ঘরে ফিরতে হবে। রাখাল ব্যস্ত হয়ে মাঠের চারদিকের ঝােপঝাড়ের আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলাে। 


আজ গাভীটিকে সঙ্গে না নিয়ে একা কেমন করে ফিরবে! চারিদিক খোঁজাখুঁজি করতে করতে রাত্রি এক প্রহর কেটে গেলাে। নেই কোথাও নেই। তার দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলাে। শূন্যমনে সে ঘরে
ফিরে এলো।
রাজকন্যা কঙ্কাবতী


পরদিন ভাের হতে না হতে রাখালের ঘুম ভেঙে গেলাে। গাভীটিকে সে খুঁজতে বের হলাে। এক গ্রাম ছেড়ে আর এক গ্রাম—সে গ্রাম ছেড়ে আরাে অনেক দূরে। এমনি করে যেতে যেতে সে রাজধানীতে এসে পৌছুলাে। 
রাজবাড়ির মালীর কাছে সন্ধান নিয়ে জানতে পারলাে, গতকাল একটি নীল রঙের গাভী রাজার ফুলের বাগানে ঢুকে গাছপালা ভেঙে তচনচ করেছে। সকল ফুলের সেরা কনকচাপার গাছটিকে খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। 

এই ফুল এদেশে আর নেই। গাছটি কঙ্কাবতীর খুব আদরের। তার হুকুমে গাভীটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
সকালবেলা রাজকন্যা মালা গাঁথার জন্য ফুল তুলতে বাগানে ঢুকলাে। 

রাখাল দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাে। তাকে দেখতে পেয়ে রাখাল ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাে।
রাজকন্যা ফুল তুলছিলাে এমন সময় রাখাল খুব ভয়ে ভয়ে পিছনে গিয়ে দাঁড়ালে; বললে : রাজকন্যা, আমি গরীব রাখাল। আমার একটি নিবেদন।


রাখাল জবাব দিলে : বাগানের মালীর কাছে আমি সে কথা শুনতে পেয়েছি। রাজকন্যা বলল আমার বাগানের সব চেয়ে সুন্দর যে কনকর্চাপা ফুল রাখাল জিজ্ঞাসা করলাে : এ ফুলের গাছ কোথায় আছে দয়া করে আমায়
এ ফুল পৃথিবীতে কোথাও নেই।
বলুন।
রাজকন্যা বললাে পরীর দেশে।
রাখাল বললাে : আমি নিশ্চয়ই সেখান থেকে ওই ফুল আর গাছ আপনাকে এনে দেবাে রাজকন্যা! কঙ্কাবতী হাসলাে। জবাব দিলাে : অসম্ভব। পরীর দেশে কোনাে মানুষ যেতে
পারে না। গেলে আর ফিরে আসতে পারে না।


রাখাল বললাে : আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আমি কনকচাপা আনতে যাবাে। যতদিন না ফিরে আসবাে ততদিন আমার কামধেনু গাভীটা আপনার কাছে থাকবে। গাভীটার বাছুর নেই বটে, কিন্তু যখনই আপনার দুধের দরকার হবে তখনই
সে দুধ দেবে।

মহারাজা সকালবেলায় বাগানে হাওয়া খেতে বের হয়েছিলেন। রাখাল পিছু ফিরতেই মহারাজার সামনে পড়ে গেলাে। তিনি রাজকন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন এ কে কঙ্কাবতী?
রাজকুমারী সকল কথা পিতাকে বললাে।

মহারাজা রাখালকে বললেন : কনকচাপা কি সত্য সত্যই তুমি আনতে
পারবে?
রাখাল করজোড়ে জানালা যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে মহারাজ, না আনতে পারলে বুঝবো আমার অদৃষ্ট মন্দ।
মহারাজ বললেন : ফুল নিয়ে ফিরে এলে অনেক পুরুষ্কার পাবে। রাখাল নত হয়ে রাজাকে প্রণাম করে যাত্রা করলাে। চলতে-চলতে-চলতে-চলতে এক রাজার রাজ্য ছেড়ে আর এক রাজার রাজ্য।

সামনে বিশাল এক ময়দান। সেই ময়দানের মাঝখানে মস্ত বড় একটি অশখগাছ। সেই গাছে বাস করে আদ্যিকালের এক ডাইনী বুড়ি। রাখাল পথ চলতে চলতে খুব
হয়রাণ হয়ে পড়েছিলাে। 

সে সেই গাছের ছায়ায় এসে বসলাে। ডাইনী বুড়ি সুড়ুৎ করে নীচে নেমে এলাে। তার মূলাের মতাে দাঁত আর
কুলাের মতাে কান দেখে রাখাল চমকে উঠলাে। 

কিন্তু বাইরে সে ভাবাকে প্রকাশ করলাে না। একগালে হেসে বললাে : কি গো দাইমা, কেমন আছাে? ডাইনী বুড়ি অবাক। সে ধীরে ধীরে বললাে : কে তুমি? তুমি বুঝি আমার
নাতি?
রাখাল বললে : তা নইলে তােমায় দাইমা বলছি। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছাে না? আমি আসছি উত্তর মুলুক থেকে। 

ডাইনী বুড়ি বললে : আ পােড়া কপাল, সে কথা বলতে হয়। এতক্ষণে
তােমায় চিনতে পারলুম। তুমি আমার মেজ মেয়ের খােকা।
রাখাল বললাে : ঠিক ধরতে পেরেছাে দেখছি। 

তা দাইমা, আমি চলেছি পরীর দেশে কনকচাপা ফুল আনতে। কেমন করে যাবাে আমায় পথ বলে দাও। ডাইনী বুড়ি বললাে : তাই তাে গাে নাতি, পরীস্থানে যাওয়া তাে সহজ নয়। আমার
এখান থেকে পূর্ব-উত্তর কোণে আছে কালু দত্যি। 

সে আমার বড় খােকা। একগাছি চুল নিয়ে যাও। তাকে এই চুল দেখিয়ে যা করতে বলবে সে তাই করবে।
এই চুলটা সঙ্গে থাকলে তােমার কোন বিপদ হবে না।
রাখাল চুলটা নিয়ে পুঁটুলি রাখলে। তারপর বললাে : তবে দাইমা, এখন চলি। পরীস্থান থেকে ফিরবার পথে তােমার সঙ্গে দেখা করে যাবাে। ডাইনী বুড়ির নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রাখাল উত্তর কোণের পথ ধরে রওনা হলাে। যেতে-যেতে-যেতে-যেতে সাত দিন সাত রাত্রি কেটে গেলাে।



 অবশেষে সে গিয়ে পৌঁছুলাে কালু দৈত্যের এলাকায়। রাখালকে দেখতে পেয়ে কালু দৈত্য হাউ-মাউ করে তেড়ে এলাে। ডাইনী
বুড়ির চুলটা দেখতেই সে নরম হয়ে গেলাে। রাখাল দৈত্যটাকে দেখে মনে মনে খুব
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে। 

তথাপি খুব সাহস করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাে: মামা
গাে, আমি তােমার ভাগ্নে। ভাগ্নে! বটে! কালু দৈত্য বলল : তুমি যদি ভাগ্নে হও তবে তার প্রামাণ
দাও।
রাখাল জিজ্ঞাসা করলাে : প্রমাণ কেমন করে দেবাে বলাে। কালু বললো :নীলদীঘিতে যে কুমির আছে তার পিঠে চড়ে যদি পারাপার হতে পারাে তবে বুঝবাে তুমি আমার ভাগ্নি।
রাখাল বলে : বেশ আমি রাজী।

রাখালকে সঙ্গে নিয়ে কালু নীলদীঘির কূলে গিয়ে হাজির হলাে। তারপর দুই হাতে তালি বাজাতেই ভীষণ চেহারার একটি কুমীর দীঘির নীল জলের ওপর ভেসে উঠলাে।
কুমির টা যেন যমদূত। তার দিকে চেয়ে রাখালের বুকটা কেঁপে উঠলাে। 

ডাইনী বুড়ির চুলটা কোমরে জড়িয়ে রাখাল এক লাফে কুমীরের পিঠের ওপর গিয়ে
বসে। কুমির জল তােলপাড় করে দীঘির মাঝখানে গিয়ে পড়লাে। অনেকক্ষণ এপার ওপার করবার পরে রাখাল আবার ডাঙায় লাফিয়ে পড়লাে। 

কালু খুব খুশী হয়ে একগাল হেসে বললাে : তাই বলে। এইবার বুঝতে পারলাম সত্যিই তুমি ভাগ্নে! তা এসেছাে যখন, দু দিন থাকো। খাও দাও আর আমােদ-ফুর্ত
করাে।
রাখাল হাসিমুখে জবাব দিলাে : মামার বাড়ি এসেছি—খাবার দাবাে আর আমােদ করবাে। কিন্তু মামা কালু হেঁড়ে গলায় বললাে : বলতে বলতে থামলি কেন বেটা। বল, কি
করতে চাস?
রাখাল বললাে : একটু বিপদে পড়ে দাইমার কাছে এসেছিলাম। সে বলে দিলাে তােমার কথা।
কালু জিজ্ঞাসা করলাে : বিপদটা তাের কি বল দেখি ?
রাখাল বললাে : আমাদের দেশের রাজার হুকুম, পুরী ফুল আনতে হবে। সেখানে যাবার ব্যবস্থাটা করে দাও মামা!
স্থানে
গিয়ে কনকচাঁপা
কালু বললে আমার একজন চাকর আছে তার নাম হিংরাজ। সে তােমাকে হিম সাগর আর লাল সাগরের পার করে পরীর দেশে রেখে আসবে। 
চেহারার একটা দৈত্য
এই কথা বলে আঙুলে তিনটি তুড়ি দিতেই ভীষণ
এসে হাজির হলাে।
কালু বললাে : শ্বেত পাহারের ওপারে যে লাল সাগর আর হিম সাগর আছে তার ওপারে পরীর দেশ। আমার এ ভাগ্নেকে সেখানে রেখে এসাে।
হিংরাজ হাত জোড় করে বললে : যে আজ্ঞা।
এই কথা বলে সেরাখালকে পিঠের ওপরে উঠিয়ে নিলাে। 

তারপর শাকরে শূন্যে উঠে মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে চললাে। ছােট বড়াে সাদা কালাে নানান রঙের মেঘগুলাে শরীরের দুপাশে আর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগলাে। রাখাল

নিচের দিকে চেয়ে দেখে, গাছপালা মাঠ ঘাট নদী নালা ঘরবাড়িগুলাে ছবির মতন দেখা যাচ্ছে।
পাহাড়, বন, সুমুদ্র পার হয়ে হিংরাজ পরীর দেশে গিয়ে পৌঁছুলাে। তারপর
রাখালকে মাটির ওপর নামিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিয়ে চলে গেলাে। 
রাখাল চারিদিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলাম।এমন আজব দেশ জীবনে কোনাে দিন সে দেখে নি। 

সুমুখে পিছনে হলুদ, লাল, জাফরান, বেগুনী ইত্যাদি নানা রঙের ফুল গাছে গাছে ফুটে রয়েছে। অজানা পাখীর মধুর কলরব। 
রাখাল অবাক হয়ে
চারিদিকে চাইতে চাইতে পথ চলতে লাগলাে। হঠাৎ দেখতে পেলাে তিনটি পরী একে অপরের হাত ধরে পথ দিয়ে নেচে
নেচে চলেছে। রাখালের সামনে এসে তারা থমকে দাঁড়ালাে। একজন পরী তাকে জিজ্ঞাসা করলাে : তুমি কে গো? মানুষ নাকি?
রাখাল জবাব দিলাে : হ্যা।
পরীটি প্রশ্ন করলাে : এই পরীর দেশে কেমন করে এলে? রাখাল বললাে : একজন দৈত্য আমাকে পৌছে দিয়েছে। 

পরী বললাে : পরীর দেশে কি জন্য এসেছাে?
রাখাল উত্তর দিলে : পরী-রাজকন্যার বাগানে কনকচাঁপা গাছ আর ফুল
আছে। আমাদের দেশের রাজার হুকুম, একটি চারাগাছ আর ফুল নিয়ে যেতে হবে।
নিয়ে গেলে আমার গর্দান যাবে। 

পরীটা বললাে : তােমার জন্য সত্যিই দুঃখ হয়। পরী-রাজকন্যার বাগানের ফুল আর গাছ তুমি পাবে না। তােমাকে যদি শহর-কোতােয়াল দেখতে পায় তবে
এক্ষুণি কয়েদ করে রাখবে। তার কথা শুনে রাখালের মুখ দিয়ে কথা সরল না। তার দু'চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লাে।
রাখালের অবস্থা দেখে পরীর মনে খুব দুঃখ হলাে। তারা তিনজনে মিলে পরামর্শ করে তাকে ঘিরে দাঁড়ালাে। 

তারপর মন্ত্র পড়ে তিনজন পর পর তার মাথায় ফুক দিতেই রাখালটা একটা পাখী হয়ে গেল। তিনজনের মধ্যে যে বড় সে-ই পাখীটাকে হাতে নিয়ে কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাে, বাড়িতে এসে তাকে খাঁচার মধ্যে
রেখে দিলাে। 
একটি মানুষকে পেয়ে পরীরা ভারী খুসী। দিনের বেলায় রাখালকে তারা


পাখী করে খাঁচার মধ্যে আটকে রাখে, রাত্রিতে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে পাখীটিকে খাঁচা থেকে বের করে মন্ত্রের দ্বারা আবার মানুষ করে। রাখালের নিকট থেকে তারা মানুষের দেশের গল্প-কাহিনী শােনে। 

রাখালের গল্প টা ছিল খুব মিষ্ট। গল্প বলার ফাকে গান গেয়ে তাদের শােনায়। পরীরা এতে খুব আমােদ পায়। তারা তিন বােনে মাঝে মাঝে নানা ভঙ্গীতে নেচে নেচে তাকে নাচ দেখায়। নাচ দেখে রাখালও খুব খুশী। 

এমনি করে তাদের সময় কাটে। হঠাৎ একদিন রাখালের মনে পড়লাে দেশের কথা—তার গাভীটির কথা।
মনটা তার চঞ্চল হয়ে উঠলাে। সেদিন রাত্রে সে পরীদের কাছে বললাে : এবারে কনকচাঁপা ফুল আর চারাগাছ একটা এনে দাও। অনেকদিন দেশ ছেড়ে এসেছি আমাকে ফিরে যেতে হবে। তার চলে যাবার কথা শুনে পরীদের মুখ মলিন হয়ে গেলাে। 

বড়াে পরীটি বললাে : এত তাড়াহুড়াে করছাে কেন? আরাে কিছুদিন থাকো। ছােট পরীটি বললাে : তুমি চলে গেলে আমার কিছুই ভালাে লাগবে না।
মেজ পরীটি বললাে আমরা তিনজনে গিয়ে তােমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবাে।
তােমার বাড়িটা আমরা দেখে আসবাে।
রাখাল উত্তর দিলাে : আমি খুব গরীব। তােমাদের এই দেশ—তােমাদের ঘরবাড়ি কেমন ঝকঝকে যেমন সুন্দর কেমন অপরূপ। 

কিন্তু আমাদের পৃথিবী এমন নয়। আমি গরীব রাখালএকখানা মাত্র ভাঙা কুঁড়েঘর আমার। সেই ঘরে
কোনাে রকমে থাকি। তােমাদের সেখানে বসতে দেবাে কোথায় বলাে? বড়াে পরীটি বললাে : সে চিন্তা তােমাকে করতে হবে না। রাখাল হাসলাে। বললে : ভাবনা দূর হলাে। ফুল তবে শীগগির এনে দাও।
ছােট পরীটা বলল : বেশ, দু'দিনের মধ্যেই এনে দিচ্ছি।
সত্যি সত্যি দু’দিন যেতে না যেতে পরীরা ফুল আর গাছ এনে হাজির করলাে। এইবার রাখালের দেশে ফিরবার পালা। 

পরীরা তিন বোন আমার সঙ্গে যাবে; সতরাং তারাও তৈরী হলাে। রাখাল পাখী হয়ে আছেসে-ও তাদের সঙ্গে উড়ে যেতে
লাগলো। নীল আকাশে মেঘের মধ্যে দিয়ে তারা চললাে। 

সাত সমুদ্র তেরাে নদী। সমুদ্র আর নদীর কালাে কাজল ঢেউগুলাের ওপরে সূর্যের সােনালি আলাে লক্ষ ধারায় ভেঙে পড়ে। হীরকের কুচির মতাে ঢেউগুলাে ঝুলতে থাকে।

উড়তে - উড়তে - উড়তে - উড়তে সাত দিন সাত রাত্রি কেটে গেলাে। তাদের পাখাগুলাে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লাে। 

ভােরবেলায় তারা মাটির ওপরে এসে নামলাে।
এইবারে পরীরা রাখালকে পাখী থেকে মানুষ করে দিলাে। রাখাল বললাে এখানে আমার একজন চেনা দৈত্য আছে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ
পরীরা বলে : চলাে।
করবাে।
রাখাল কালু দৈত্যের বাড়িতে এসে হাজির হলাে।
কালু সমাদর করে তাদের বসতে দিলে।
রাখাল বলে :মামা, তােমার দয়াতেই আমি পরীর দেশে যেতে পেরেছিলাম। 

সেখান থেকে ফুল এনেছি এবার দেশে ফিরে যাবাে। কিন্তু পরীস্থান থেকে তিনজন পরী এদেশে বেড়াতে এসেছে, আমার ভাঙা কুঁড়েঘরে তাদের নিয়ে যাবাে কেমন
করে?
কালু হেসে বললাে : এই কথা! আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি, বলে সে হাতের আঙুলে তিনটা তুড়ি দিলে। এই কথা তৎক্ষণাৎ হিংরাজ এসে হাজির হলাে। দুই হাত যুক্ত করে বললাে : হুকুম
হুজুর।
কালু আদেশ করলাে : উত্তর দেশের রাজার যে রাজপুরী আছেতার ওপাশে মস্ত বড়াে একটা মাঠ আছে। সেই মাঠের মাঝখানে ঠিক রাজবাড়ীর মতাে একটা বাড়ি তৈরী করাে। তিন দিনের মধ্যেই বাড়িটা শেষ হওয়া চাই।

হিংরাজ বললাে : যে আজ্ঞা।
কালু বললে : যাও আবার কাজ আরম্ভ করাে। কালু বললাে : ভাগে, সেদিন তােমাকে আদর যত্ন করতে পারি নি। আজ
হিংরাজ চলে গেলাে।
তিনজন অতিথি তােমার সঙ্গে রয়েছে। তােমরা সবাই আজ এখানে বিশ্রাম করাে। রাখাল হাসিমুখে রাজী হলাে। তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেলাে। তারপর রাখাল বিদায় নিয়ে পরীদের সঙ্গে উত্তর দেশের পানে রওনা হলাে। 

তারা আকাশপথে উড়ে চলেছিলােহঠাৎ এক সময়ে নীচের দিকে চেয়ে রাখাল বললে ওই যে খুব বড়াে অশথগাছটা দেখতে

পাচ্ছা-ওইখানে বাস করে ডাইনী বুড়ি। ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরীরা বলে : চলাে। রাখাল তাদের নিয়ে অশথগাছের নীচে গিয়ে হাজির হলাে।
রাখাল ডাকলাে : দাইমা।
ডাইনী বুড়ি গাছের ওপর থেকে সুড়ৎ করে নীচে নেমে এলাে। রাখাল আর পরী তিনজনকে দেখে বলে : এসাে এসাে নাতি—তোমরা সবাই বসাে। এই কথা বলে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসতে দিলে। নারীদের দিকে
চেয়ে ডাইনী বুড়ি রাখালকে জিজ্ঞাসা করলাে : ওগাে নাতি এদের সবাইকে কি তুমি
বিয়ে করেছে?

রাখাল লজ্জিত মুখে জবাব দিলাে না দাইমা, আমাদের বিয়ে হয় নি। ডাইনী বুড়ি বললাে : তানা-ই বা হলাে। তােমরা আমার বাড়িতে এসেছাে আমি খুব খুশী হয়েছি। আমি কিছু উপহার দিচ্ছি তােমরা নাও।

ডাইনী বুড়ি রাখালকে দিলাে অনেক দামী পােশাক। পরী তিনজনকে উপহার
দিলাে মণি-মুক্তার অলংকার। চমৎকার শাড়ী আর গহনাগুলাে পরে পরীরা তিন বোনের ঝলমল করতে লাগলাে। 

বুড়ির বাড়িতে অনেক মিঠাই-মণ্ডা খেয়ে রাখাল আর পরীরা দেশের দিকে রওনা হলো।
নিশুতি রাত। এমন সময়ে তারা এসে হাজির হলাে রাজবাড়ির পাশে। ওপাশে
যে ফাকা মাঠ ছিলাে সেখানে উঠেছে মস্ত বড় একটা বাড়ি। পরীদের সেখানে রেখে সে ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগিয়ে এলাে। 
বললাে : আপনাদের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। রাখাল পরদিন সকালবেলা রাজদরবারে গিয়ে হাজির হলাে। 

মহারাজকে
অভিবাদন জানিয়ে বললাে : হে রাজ, আমাকে বােধ হয় চিনতে পারছেন না! আমার গাভীটি আপনার বাগানের কনকচাঁপা গাছটি খেয়ে ফেলেছিলাে। আমি সেই গাছ আনতে পরীস্থানে গিয়েছিলাম। সে সকল নিয়ে আজ ফিরে এসেছি।
রাজা অবাক হয়ে রাখালের দিকে চেয়ে রইল। 

এ যেন সে নয়। পােশাক পরিচ্ছদে তাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে বললেন : তােমাকে সত্যিই আমি চিনতে পারি নি। এ সকল সাজ-পােশাক তুমি কোথা থেকে পেলে? রাখাল জবাব দিলাে : সব কিছু আপনাকে পরে বলছি মহারাজ! এই ফুল আর চারাগাছটি নিন।

এই বলে রাখাল অনেকগুলাে ফুল আর গাছটি বের করে রাজার সুমুখে রাখলাে।
রাজা ফুল আর গাছ পেয়ে খুব খুশী হলেন। 

তিনি সিংহাসন থেকে উঠে গিয়ে রাখালকে আলিঙ্গন করলেন। বললেন : তােমার সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি বৎস। 

তুমি দীর্ঘজীবী হও।
এমন সময় শহর-কোতােয়াল এসে রাজাকে বললাে : মহারাজ, রাজপুরীর ওপাশে যে বিশাল প্রান্তর ছিলাে সেখানে রাজবাড়ির মতাে একটা বাড়ি উঠেছে। জানি না, এতাে বড়াে ধনী হঠাৎ কে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছে!
রাখাল মাথা নীচু করে বললাে : মহারাজ ওটা আমার। 

রাজা এবং রাজসভার লােকজনেরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাে। রাজা তার হাত ধরে বললেন : তােমার কামধেনু গাভীটা আমার কাছে রেখে
গিয়েছিলে, সেটা ফেরত নাও। 

তার সঙ্গে তােমাকে দেবাে অর্ধেক রাজত্ব আর
রাজকন্যা কঙ্কাবতী।
রাখাল মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাে। তারপর?
তারপর রাজপুরীর তােরণে তােরণে নহবৎ বসলাে। 

রাজ্যময় মহা হৈ-চৈ মহা কলরব শুরু হলাে।
রাখালের সঙ্গে রাজকন্যা কঙ্কাবতীর বিয়ে হয়ে গেলাে। রাজকন্যাকে নিয়ে পরম সুখে রাখালের দিন কাটতে লাগলাে।

No comments:

Post a Comment

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...