রাক্ষসপুরী
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
নগর পারে রূপনগর। তা সেই রূপনগরের রাজার ছেলে রূপে গুণে কার্তিকেয়। কী চমৎকার যে দেখতে তা বলবার নয়। কথায় বলে রাজপুত্র। তা এই রাজপুত্র যেন সবার সেরা।
রাজপুত্রের বয়স যখন ষোল, রাজামশাই তখন ঠিক করলেন এবার তিনি কোনও এক শুভদিনে রাজ্যভিষেক করে রাজপুত্রকে যুবরাজ পদে অভিসিক্ত করে রাজসভায় নিয়ে নেবেন। এবং পরে সুযােগ সুবিধা
মতাে সিংহাসনের পূর্ণ দায়িত্ব রাজকুমারের হাতে তুলে দিয়ে অবসর নেবেন তিনি। রাজার অন্তরের এই সুপ্ত বাসনাটা মেনে নিল সকলেই। নেবে নাই বা কেন? রাজার ছেলেই রাজা হবে এ তাে সবাই জানে। কিন্তু মেনে নিল না একজন। সে রাজপুত্র স্বয়ং।
রাজপুত্র বলল,“মহারাজ! আপনি আমার পিতা। আপনার হুকুম অমান্য করবার মতাে সাহস আমার নাই। আমার রাজসিংহাসন চাই না এ কথাও আমি বলব না। আমার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। লেখাপড়া থেকে যুদ্ধবিদ্যার সবকটি ধাপ আমি পার হয়ে এসেছি। কিন্তু তবুও আমার একটা দিক অপূর্ণ আছে?” রাজামশাই বললেন, "কি রকম!"
আমি সব কিছুই জেনেছি। শুধু নিজের দেশটাকেই জানিনি। তাই এই পদে অভিষিক্ত হবার আগে প্রজাদের সুখ দুঃখ এবং রাজ্যের সীমা সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা করে নিতে চাই। অতএব আমি আমার রাজ্য ঘুরে দেখার জন্য আরও ছ'মাস সময় পাইনি।” রাজামশাই বললেন, এই কথা! সে ব্যবস্থা আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। ছ'মাস
কেন? একমাসে যাতে সে কাজ হয়ে যায় সে ব্যবস্থাও করে দেবাে আমি। তােমাকে নিয়ে যাবার জন্যে রথ এখুনি প্রস্তুত হবে। আমার পাঁচ হাজার সৈন্য তােমার সামনে পিছনে থাকবে। গদি বিছানা সমেত তাবু যাবে। বলেই হাঁক দিলেন, "মন্ত্রীমশাই!
আপনি এখুনি রাজকুমারের নিরাপত্তামূলক সবরকমের ব্যবস্থা করুন।” রাজকুমার বললেন,“উহু। ওইভাবে আমি যাবাে না তার কারণ আমি তাে প্রমােদ ভ্রমণে যাচ্ছি না।
আমি যাচ্ছি নিজের দেশকে চিনতে জানতে। কাজেই আমি যাবাে ঘােড়ায় চেপে তরােয়াল হাতে বীরের মতাে। আর আমার সঙ্গে যাবে মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র এবং কোটালপুত্র। সেই সুযােগে তাদেরকেও আমি বাজিয়ে দেখতে চাই।
মহারাজের তাে মােটেই ইচ্ছা নয় রাজকুমারকে এইভাবে ছাড়তে। আর রাজপুত্রেরও জেদ এইভাবেই সে যাবে। রাজপুত্রের জেদ দেখে মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল কেউই না করল না তাদের ছেলেদের ছাড়তে।
অতএব কোনও এক শুভদিনে রাজারাণীকে প্রণাম করে রাজপুরী থেকে বিদায় নিলেন রাজপুত্র। সঙ্গে চলল মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্র। যাইহােক, তারা এ দেশ ও দেশ করে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের সীমা এবং প্রজাদের দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানল। কাদের কী অভাব, কিসের প্রয়ােজন, কী পেলে খুশি হয় সব
জেনে এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করল। সে কী নিবিড় গভীর বন। দিনের বেলাতেও সেখানে সূর্যের আলাে পৌঁছায় না। তা সেই বনের মধ্যে এক জায়গায় একটি নদী ও ঝবনা দেখে বিশ্রাম করতে বসল ওরা। তখন দুপুরবেলা। ক্ষুধায় ওরা কাতর সকলে।
এমন সময় ওরা দেখল একদল ময়ূর ওদের সামনে এসে পেখম মেলে নাচছে। দেখে মন ভরে গেল ওদের। যাক।”
কোটালপুত্র বলল, “আপাতত একটা মযুর মেরে খাওয়া রাজপুত্র বলল, "না। দেখছ না ওরা কত সুন্দর। আমাদের দেখে আনন্দ হয়েছে ওদের, তাই এত নাচছে। ওদের কখন মারে?” তারপর এসে দাঁড়াল একদল হরিণ।
সেনাপতি বলল, তা হলে কি এই হরিণই একটা বধ করা যাবে? এই কথা শােনামাত্রই দেখা গেল একটা হরিণ এসে ওদের পায়ের সামনে গড়াগড়ি খেতে লাগল। অর্থাৎ আকারে ইঙ্গিতে সে বােঝাতে চাইল, হে কুমারগণ!
তােমরা আমাকে আহার করেই তৃপ্ত হও।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 1
রাজপুত্র বলল, হরিণের মাংস অতি সুস্বাদু। তবে কিনা যে আমাদের ভালবেসে এবং আমাদের ক্ষুধার কথা চিন্তা করে নিজের থেকে তার দেহ দান
করতে আসছে তাকে কখনও বধ করা উচিত নয়।” রাজপুত্রের এই কথা শােনামাত্রই সেই বনে যত পশুপক্ষী ছিল সবাই একসঙ্গে তাদের নিজের নিজের ভাষায় কেউ ডেকে কেউ শিস দিয়ে জয়ধ্বনি করল। আবার ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল একদল হনুমান কী যেন সব বয়ে নিয়ে আসছে।
হনুমানগুলাে যা নিয়ে এল তা হল এই। কেউ নিয়ে এল পাকা কলা, কেউ গাছপাকা পেঁপে, কেউ বা আম, জাম। কেউ পেয়ারা। তাছাড়া আরও কত কী সুস্বাণু
ফল।
রাজপুত্র তাে খুব খুশি। বন্ধুদের নিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সেই সব খেতে লাগল। তারপর যা হল তা আবার আরও মজার। ওরা করল কি কোথা থেকে যেন কচি ঘাস ছিড়ে এনে গাছতলায় বিছিয়ে বেশ পুরু গদীর মতাে করে বিছানা করে দিল। তারপর আকারে ইঙ্গিতে ওদের শুতে বলে শুরু করল ওদের গা হাত পা টেপা। শুধু তাই নয়, বনের পশুপাখি সবাই মিলে সারারাত জেগে ওদের ঘিরে পাহারা দিতে লাগল।
রাজপুত্র বলল,“বনের পশু। এদের আমরা বন্য প্রাণী বলেই জানতাম। কিন্তু এদের বুকেও যে এত বাৎসল্য, স্নেহ, মমতা আছে তা তো জানতাম না। সেইজন্যেই যেখানে বনের ফলমূলের রসাস্বাদন করে আমাদের পেট ভরে সেখানে অযথা আমরা এইসব প্রাণীগুলােকে মেরে খাই। যাই হােক, আমি যখন রাজা হবাে তখন এ দেশ থেকে প্রাণী হত্যা একদম বন্ধ করে দেবাে। আর বলে দেবাে এই বন থেকে একমাত্র
শুকনাে গাছ ছাড়া অন্য কোনও গাছের একটা ডালও কেউ যেন না কাটে।” তাই না শুনে হনুমানগুলাের উপ আপ করে সে কী লাফানি। কতকগুলাে বাঁদরও আবার জুটে গেল তাদের সঙ্গে। তারা মু মু করে কী সব বলতে
লাগল। যাই হােক, বনের পশুরা সেবা-যত্নের কথা বলতে বলতেই রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্র গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। সেই ঘুম যখন ভাঙল তখন সােনার বরণ তরুণ তপন অরুনরাগে ভুবন যেন ভরিয়ে দিয়েছে।
সােনা রােদের ছটা লেগে গাছের পাতা চিক চিক করছে। নদীর বালি চিকচিক করছে। ঝরনার জলে রামধনু হচ্ছে। যাই হােক, রাজপুত্র সকলকে নিয়ে নদীর জলে মুখ হাত ধুয়ে ফলটল খেয়ে ঘােড়ায় চেপে বসল। কিন্তু মুশকিল হল নদী পার হতে গিয়ে। যেই না ওরা নদীতে নামল অমনি চিৎকার করে উঠল সকলে। সেইসঙ্গে কি লাফালাফি।
ব্যাপারটা যে কী তা ওরা কেউই কিছু বুঝতে পারল না। ভাবল ওরা চলে যাচ্ছে তাই বিদায় দিতে কষ্ট হচ্ছে বলেই বুঝি ওইরকম করছে ওরা। হনুমানগুলাে তাে ওদের পা ধরে ঝুলে পড়ল।
কিন্তু তবুও ওরা বুঝতে পারল না ওদের কথা। জোর কদমে ঘােড়া ছুটিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাল সকলকে। অভিবাদন তাে জানাল। কিন্তু কী দেখল? দেখল হরিণের চোখে জল। ময়ূর
কাদছে। বাঁদর হনুমানের দল বুক চাপড়াচ্ছে। পাখিরা কলরব করে মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, নদীর এপারে কেউ আসছে না। মন্ত্রীপুত্র বলল, ব্যাপারটা কী বল দেখি? নিশ্চয়ই ওরা আমাদের এইদিকে
আসতে মানা করছে।”
রাজপুত্র বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।” সেনাপতি বলল, “এই হিতৈষিদের আবেদন শুনে আমাদের কিন্তু ফিরে
যাওয়া উচিত।” কোটালপুত্র বলল, "আমিও তাই মনে করি।”
রাজপুত্র বলল, “হ্যা আমিও এ ব্যাপারে একমত। তবে কিনা ফিরে আমরা
যাব না, দেখব এর আসল রহস্য কোনখানে। ওদের ভয়ের ব্যাপার যদি এখানে কিছু থাকে তবে তা আমরা নির্মূল করব।” বলেই ওরা রহস্যাভিযানের জন্য ছুটিয়ে দিল ঘােড়াগুলাে। নদীর ওপারে ছিল মরুভূমি। তাই ঘোড়া ছুটছে তাকে ছুটছেই। তবে মরুভূমি বলতে একেবারে ধু ধু বালুর মরুভূমি নয়। কোথাও বালি মাটি, কোথাও বা শক্ত পাথর।
যাই হােক, অনেকদূর যাবার পর সে মরুভূমির বুকে ওরা একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখতে পেল। কিন্তু সেই প্রাসাদ বড়ই রহস্যময়। সেখানে না আছে লােকজন না আছে কিছু। শুধুই প্রাসাদ। আরও মজার ব্যাপার এই যে সেই প্রাসাদে প্রবেশ করবার মতাে দরজা কোথাও নেই।
চারিদিকেই বৃত্তাকার পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাজপুত্র বলল, “বেশ মজার ব্যাপার দেখছি। এই প্রাসাদে যারা থাকে তারা বেরােয় কোথা দিয়ে! আর ঢােকেই বা কী করে?” কোটালপুত্র বলল “দাঁড়াও, এর রহস্য আমি বের করছি।” বলেই সেই
পাঁচিলের কাছে ঘােড়া নিয়ে গিয়ে তার পিঠে পাঁচিলের ওপর উঠল। উঠেই ভেতর
দিকে তাকিয়ে হাে হাে করে হেসে লাফিয়ে পড়ল ভেতরে। কিন্তু সেই যে লাফাল আর উঠল না। এরা তাদের বাইরে থেকে অনেক চেঁচামেচি করল। ডাকাডাকি করল। কিন্তু
কোনও সাড়া নেই শব্দ নেই। অবশেষে সেনাপতিপুত্র বলল, "দাঁড়াও এবার আমি উঠে দেখি ব্যাপারটা কী
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 2
মন্ত্রীপুত্র বলল, "সোনা ভাই, তুমি কিন্তু ওর মতাে কোরাে না। যা দেখবে
তা আগে বলবে। তারপরে ওর খোঁজ করাে। কেমন?
সেনাপতিপুত্র বলল, “সে কথা আবার বলতে।” বলেই ঘোড়ার পিঠে পা দিয়ে পাঁচিলে উঠল। উঠেই ভেতর দিকে তাকিয়ে হা হাে করে হেসে লাফিয়ে পড়ল ভেতরে।
রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মন্ত্রীপুত্র বলল, এটা নিশ্চয়ই কোনও মায়াপুরী। আর তারই প্রভাবে ওরা এইরকম করল। আমাদের মনে হয় আর এই বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
চলাে আমরা ফিরে যাই।”
রাজপুত্র বলল, 'তা হয় না ভাই। ফিরলে আমরা চারজনেই ফিরব। না হলে
কেউ নয়। এবারে দেখার পালা তোমার। মন্ত্রীপুত্র বলল, “তাই হােক তবে। এবার তা হলে আমিই দেখি। এই বলে মন্ত্রীপুত্রও ঘােড়ার পিঠে পা দিয়ে পাঁচিলে উঠল এবং ওই একইরকমভাবে ভেতরে লাফিয়ে পড়ল।
রাজপুত্র আর বাকি থাকে কেন? সেও পাঁচিলে উঠল। বলা বাহুল্য তার বেলাতেও এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হল না। ওরা চারজনেই প্রাসাদের ভেতরে উঠানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখন
সবাই সবাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ক্রমে দিন গেল। সন্ধ্যে হল। আর ঠিক সেই সময় ওরা দেখতে পেল ভয়ঙ্কর রাক্ষসী আকাশপথে উড়ে এসে ও দের সামনে দাঁড়াল।
কী বিশাল চেহারা। রাক্ষসী ওদের দেখে হাে হাে করে হেসে উঠে এক হাতের মুঠোয় চারজনকে নিয়ে একটা বড় হল ঘরে এল। সেই ঘরের এক কোণে একটা বড় উনুনে প্রকাণ্ড একটি তেলভর্তি কড়া বসানাে আছে। আর তার চারিদিকে ছড়ানাে আছে অসংখ্য হাড় গােড় ইত্যাদি।
রাক্ষসী ওদের চারজনকে সেই ঘরের মেঝেয় চিৎ করে শুইয়ে হাতে পায়ে গজাল মেরে মাটির সঙ্গে গেঁথে রাখল। তারপর বিকট হাসি হেসে বলল, আমি বহুদিন ধরে একটু সুস্বাদু মাংস খাবার চেষ্টা করছিলুম। বাঁদর, হনুমান, গরু, ছাগল খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে।
এইবার তােদের খেয়ে আশ মেটাবাে। আগে কাল সকালে তােদের ঘােড়াগুলােকে ভেজে খাবাে। তারপর এক একদিন তােদের এক একজনকে খেয়ে অরুচি কাটাব। এখন শুয়ে তােরা মরণের প্রতীক্ষা কর।” এই বলে চলে গেল রাক্ষসী।
রাক্ষসী চলে গেল তাে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল সকলে। কাঁদবে নাই বা কেন, এ জীবনের মতাে ঘরে ফেরার আশা, বাবা মাকে দেখবার আশা সবই তাে দুরাশা হয়ে গেল। তাই কাদতে লাগল। কিন্তু কথায় বলে না অরণ্যে রােদন, তা ওদের কান্না শুনবে কে?
মন্ত্রীপুত্র বলল, “ভাইরে, এইখানে এইরকম বিপদ ঘটতে পারে জেনেই বনের পশুপক্ষীরা অত বাধা দিয়েছিল আমাদের। যেমন আমরা মানিনি তাদের বাধা, তেমনই এখন হাতেনাতে তার ফল আমাদের ভােগ করতেই হবে। যাই হােক, এইভাবে রাত্রি তাে প্রভাত হল।
সকালবেলা রাক্ষসী এসে বিকট মূর্তি ধরে আগে খানিকটা হাসল। তারপর
বলল, "কী বাছাধনরা। কেমন লাগছে? এইবার আমার খেলা দেখাে?" বলেই সেই তেলের কড়ায় জাল দিয়ে একটা করে ঘােড়া এনে গরম তেলে মুচমুচে করে ভেজে খেয়ে ফেলল। সে দৃশ্য সত্যিই দেখা যায় না। অত সাধের ঘােড়া ওদের। কত দেশ দেশান্তর
ঘুরিয়ে নিয়ে এল। অথচ কী তাদের পরিণতি। রাক্ষসী ঘােড়াগুলােকে খেয়ে বলল, আঃ বাঁচলাম। কতদিন যে ঘােড়ার মাংস খাইনি। এবার কাল থেকে শুরু করব এক একদিন তােদের এক একজনকে খাওয়া। কাল কার পালা হবে তােরাই ঠিক করে রাখ। এখন আমি চরতে যাচ্ছি।”
এই বলে শন শন করে উড়ে চলে গেল রাক্ষসী।
সেই দিন রাত যে কীভাবে কাটল তা ওরাই জানে। কাল সকালে যে কার পালা সেই কথা ভাবতে ভাবতে রাত কাবার হয়ে গেল। ঘুম এল না কারও চোখেই। পরদিন সকালে যথারীতি রাক্ষসী এল। এসেই বলল, “কি রে, কিছু ঠিক
করলি কাকে খাবাে আজ? রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতি পুত্র, কোটালপুত্র সবাই একসঙ্গে বলল, "আমাকে আগে খাও।”
তাই না শুনে রাক্ষসী বলল, যাঃ বাবা! তােরা ভয়ে কাদবি কোথায়, প্রাণ ভিক্ষা চাইবি তার জায়গায় মরবার জন্য ছটফট করছিস? তা ঠিক আছে, আমিই আমার খাবার বেছে নিচ্ছি।” বলেই কোটলপুত্রকে হেঁচকা টানে গজল শুদ্ধ উপড়ে এনে তেলের কড়ায় ফেলে দিল। তারপর বেশ মড়মড়ে করে ভেজে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, কাল সাকালে আবার আসব। খাবাে তােদের একজনকে।
কোটালপুত্রের পর স্বাভাবিক ভাবেই পালা আসে সেনাপতিপুত্রের। তাই আগামীকাল সেনাপতিপুত্রকে তেলের কড়ায় মড়মড়ে করে খেয়ে রাক্ষসী চলে গেল।
দিন গেল। রাত এল।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 3
কাল সকালে মন্ত্রীপুত্রের পালা।
রাজপুত্র বলল, ভাইরে কোনওরকমে কি এই ভয়ঙ্করীর গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না?" মন্ত্রীপুত্র বলল, “আমিও তাে সেই কথাই ভাবছি ভাই রাজকুমার। আমি
মরব। কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে যদি তােমার জীবন আমি রক্ষা করতে না পারি তা হলে বৃথাই এ জীবন।”
রাজপুত্র বলল, “তুমি তাে অনেক বুদ্ধি রাখাে ভাই। দেখাে না একটু মাথা খাটিয়ে কোনও উপায় কিছু বার করতে পারবে না।" মন্ত্রীপুত্র বলল, বেশ। আমাকে একটু তা হলে ভেবে দেখার সময় দাও।”
মন্ত্রীপুত্র অনেকক্ষণ ধরে ভেবেচিন্তে একসময়ে বলল, একটাই উপায় আমার
মাথায় এসেছে। সেই উপায়টা কাজে লাগাতে পারলে হয়তাে আমরা বাঁচতে পারি। রাজপুত্র আশান্বিত হয়ে বলল, “কি উপায়! কি উপায়!” “তাতে কিন্তু কষ্ট খুব। আর বিপদের ঝুঁকিও অনেক।
"বিপদের আর বাকিটা কী আছে? কাল সকালে হয় তুমি না হয় আমি দুজনের
মধ্যে যে কেউ রাক্ষসীর পেটে যাবাে। পরশুর মধ্যে দুজনেরই পালা শেষ।” তাহলে এসাে আমরা বাঁচার চেষ্টা করি।” বলেই মন্ত্রীপুত্র গায়ের জোরে হেঁচকা টান দিয়ে একটা হাত কে গজালমুক্ত করল। হাতের তালুর মাঝখানটা গর্ত
হয়ে গেল তাতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। একটা হাত হতেই আর একটা হাত।
তারপর দুটো পা।
মন্ত্রীপুত্র নিজে মুক্ত হয়েই রাজপুত্রকে টেনে হিচড়ে গজল মুক্ত করল। তারপর সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্রের ছিন্ন পরিত্যক্ত পােশাক ছিড়ে হাতে পায়ে ব্যাণ্ডেজ করে পা টিপে টিপে ওপরে এল। ওপরে উঠেই দেখল রাক্ষসীটা দরজা আগলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
সে কী নাক ডাকার শব্দ তার। ওরা কোনরকমে পা টিপে টিপে শুয়ে রাক্ষসীটার পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে এল। তারপর বারান্দার কাছে এসে রেলিঙে একটা দড়ি বেঁধে টুপটাপ করে নেমে পড়ল সেই পাঁচিলে। আর তারপরেই ধুপ ধাপ করে লাফিয়ে নামল বালিতে।
নেমেই ছুট-ছুট ছুট। ঘােড়ার খুরের দাগ লক্ষ করে প্রাণপণে ছুটতে লাগল দুজনে। তবে কিনা একে, তাে বালির ওপর দিয়ে ছােটা যায় না তার উপর কাটা ছেড়া পা নিয়ে ছােটা। তাই দারুণ কষ্ট হল ছুটতে।
ছুটতে ছুটতে ভাের হয়ে এল। তারপর সকাল। যেই না সকাল হল অমনি পুব দরজা দিয়ে সূর্যের আলাে এসে রাক্ষসীর মুখের ওপর পড়ল। এইভাবেই রােজ ওর ঘুম ভাঙে। আজও ভাঙল। রাক্ষসী তাে আড়মােড়া ভেঙে নিচে এসেই দেখল পাখি ফুডুত। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দেখল রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র অনেক-অনেক দূরে চলে
গেছে। অমনি সে বন বন করে শন শন করে বিকট হাঁক ডাক পেড়ে উড়ে চলল ওদের ধরার জন্যে।
রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র তখন নদীর কাছাকাছি। যেই না ওরা নদীর কাছাকাছি এসেছে অমনি বনের সেই পশুপক্ষীদের সে কী আনন্দ উল্লাস। বাঁদর হনুমানের দল তাদের লম্পঝম্প করে হাত নেড়ে উ আপ
কিচ কিচ করে ডাকতে লাগল ওদের। মন্ত্রীপুত্র ওদের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে
রাজপুত্রকে বলল, “শিগগির চলাে ভাই। মনে হচ্ছে এই নদীটাই রাক্ষস রাজ্যের সীমানা। এইজন্যই বাঁদর হনুমানের দল আমাদের নদী পার হতে বলছে।” রাজপুত্র বলল, “হ্যা। তা বেশ ভালােই বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া পিছনে ওই দেখাে রাক্ষসী কেমন ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে। ওরা দুজনে ছুটে এসে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ল।
আর অমনি সেই বাঁদর হনুমানের দল ছুটে এসে হাত ধরে ডাঙায় তুলল
ওদিকে রাক্ষসী টা তখন উড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়েছে নদীর ওপারে বালুচরে।
ওদের।
রাগে থরথর করে কাপছে তখন রাক্ষসী। ভীষণ চিৎকার করে রাক্ষসী বলল,
যাঃ। খুব জোর বেঁচে গেলি এ যাত্রা। এই প্রথম আমার শিকার আমার গ্রাস থেকে
পালিয়ে বাঁচল।তবে তােদের জন্যে প্রতীক্ষা করব আমি। আবার একদিন না একদিন
পথ ভুলে এদিকে আসতে হবে তােদের। নেহাত এই নদী পার হবার অধিকার নেই
আমার তাই। নাহলে তােদের চিবিয়ে খেলাম। বলে গর্জন করতে করতে চলে
গেল। আর ক্লান্ত রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র একটি গাছতলায় শুয়ে হাঁফাতে লাগল। বাঁদর হনুমানের দল খুব সেবাযত্ন করতে লাগল ওদের। কলাগাছের পাতা মুড়ে বটের পাতায় খিলি করে হরিণের দুধ এনে খাওয়া। ফলমূল খাওয়াল।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 4
আর এক বৃদ্ধ হনুমান করল কী বনের ভেতর থেকে কী সব লতাগুল্ম এনে সেগুলাে দাঁতে চিবিয়ে ওদের যথাস্থানে লাগিয়ে দিল। অব্যর্থ ওষুধ। রাতারাতি সব ঠিক হয়ে গেল। ব্যাথা বেদনা দূর হল। এমনকি হাত-পাণ্ডে দেখে মনে হল যেন ওখানে
কোনও দিন কিছুই হয়নি। যাই হােক, দিন দুই বিশ্রাম নেবাল পরই রাজপুত্র ও মন্ত্রিুত্র চাঙ্গা হয়ে উঠল
অনেকটা। শরীরে আবার আগের মতাে বল ফিরে পেল। তাই ওরা বাড়ি ফেরার জন্য পথ হারিয়ে সেই বনের আরও গভীরে ঢুকল।
তৃতীয় দিন রাত্রিবেলা গভীর বনে রাজপুত্র যখন একটি গাছের ডালে বসে ঘুমাচ্ছে তখন হঠাৎ ফোস ফোঁস শব্দে রাজপুত্রের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই রাজপুত্র দেখল একটা অজগর সাপ আস্ত হরিণকে ধরে গিলে খাচ্ছে আর সেই বন কিসের আলােয় যেন আলােকিত হয়ে আছে।
রাজপুত্র চুপিচুপি মন্ত্রীপুত্রকে ডেকে সেই দৃশ্যটা দেখাল। মন্ত্রীপুত্রও অবাক। ওয়া দুজনে দেখল হরিণটাকে গিলে খেয়ে অজগর আবার ফোস ফোঁস করতে করতে সেই গাছের কাছে এল। তারপর গাছতলা থেকে একটি চকচকে জিনিস মাথায় নিয়ে বড় একটি গর্তের ভেতরে ঢুকে গেল। আর যেই না যাওয়া আবার
সেই ঘাের অন্ধকার।
সে রাতে আর ঘুম হল না কারও, নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে জেগেই কাটাল দুজনে।
মন্ত্রীপুত্র বলল। "অজগর যেটা মাথার উপর করে নিয়ে গেল সেটা কী তা
জান?
রাজপুত্র বলল, দেখিনি কখনও। তবে বুঝতে পেরেছি। সাত রাজা ধন এক মানিক।”
“হ্যাঁ, এখন থেকে ওই মণিটি লাভ করার জন্যে আমাদের খুব সজাগ এবং তৎপর থাকতে হবে। কাল রাতে অজগর যদি আবার শিকার ধরতে আসে তা হলে। ওই মণিটা আমরা উদ্ধার করব।”
এই কথামতাে পরদিন সকাল হতেই মন্ত্রীপুত্র করল কী খুঁজে পেতে এক জায়গা থেকে খানিকটা গােবর কুড়িয়ে এনে গাছতলায় রেখে দিল। তারপর রাত্রিবেলা
গাছের ডালে চুপচাপ বসে রইল দুজনে।
মাঝরাতে মণি মাথায় নিয়ে অজগর আবার সেই গর্ত থেকে বেরুলাে। তারপর গাছতলায় মণিটি রেখে যেই না শিকার ধরতে চলে গেল অমনি মন্ত্রীপুত্র করল কী সেই গােবরটা এনে চাপা দিয়ে দিল মণিতে। গােবর ঢাকা দিতে আর কোনও আলােই
বেরলাে না তখন। এদিকে অজগর শিকার করে বন বিচরণ করে ফিরে এসে তার মণি দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে মাথা খুঁড়ে মরে গেল।
সাপটা মরে গেলেও ওরা নামল না। নামল ঠিক পরদিন সকালে রােদ উঠলে। রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র ল কি সেই গােবরমাখানাে মণি নিয়ে সেটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করবে বলে জলের সন্ধানে এগিয়ে চলল, খানিকদূর যাবার পর ওরা দেখল একটা
সমুদ্র অনন্ত জলরাশি নিয়ে ঢেউ সমেত তীরে এসে আছড়ে পড়ছে।
তা মন্ত্রীপুত্রকে বসিয়ে রেখে রাজপুত্র গেল মণিটা ধুতে। কিন্তু অবাক কাণ্ড।
রাজপুত্র যত এগােয় সমুদ্র ততই দু’ভাগ হয়ে গিয়ে রাজপুত্রকে পথ করে দেয়। খানিক যাবার পরেই রাজপুত্র সমুদ্রের নিচে একটা সিঁড়ি দেখতে পায়। সেই সিঁড়ি বিয়ে সবে কয়েকধাপ নেমেছে অমনি আবার জলে ঢেকে গেল সব।
মন্ত্রীপুত্র তাে অনেক ডাকাডাকি করতে লাগল তীরে বসে। সে বারবার চিৎকার
করে বলতে লাগল “রাজকুমার ফিরে এসাে। ফিরে এসাে রাজকুমার! দরকার নেই
পাতালপুরীতে যাবার।”
কিন্তু কে শােনে কার কথা? সমুদ্রের ভয়ঙ্কর গর্জনে সব কিছুই চাপা পড়ে গেল। মন্ত্রীপুত্র তখন বাধ্য হয়ে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে রাজ্যে ফিরে এসে কাদতে কাদতে সব বলল - হারাজকে।
রাজপুরীময় শোকের ছায়া নেমে এল। এদিকে হল কী, রাজপুত্র পাতালপুরীতে প্রবেশ করেই দেখল অবাক কাণ্ড। সে এক বিশাল পুরী। কিন্তু পুরীতে কোনও লােকজন নেই। থরে থরে খাবার সাজানাে আছে, কিন্তু দোকানি নেই। ফুলের বাগান আছে, মালি নেই।
রাজপুত্র বুঝল আবার সে নতুন করে মায়াপুরীতে এসে পৌছেছে। যাই হােক, তবুও রাজপুত্র তাে পালাতে জানে না। তাই একটা দোকানে বসে বেশটি করে পেট পুরে খাবারদাবার খেয়ে রাজপুরীতে ঢুকল। এ ঘর ও ঘর করে হঠাৎ একটি ঘরে ঢুকেই চমকে উঠল সে।
যা সে চোখে দেখল তাতে নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারল না। এ কী দেখছে সে। একই অঙ্গে এত রূপ। এও কখনও সম্ভব! সে দেখল এক অপরূপ রূপ লাবণ্যবর্তী রাজকন্যা সোনার খাটে শুয়ে পরম শান্তিতে ঘুমােচ্ছে। সেই রাজকন্যার মাথার কাছে আছে একটা সোনার কাঠি আর একটি রূপার কাঠি। রাজপুত্র অনেক চেষ্টা করল রাজকন্যার ঘুম ভাঙাবার।
কিন্তু শত ডাকেও সে ঘুম ভাঙল না। যখন কিছুতেই কিছু হল না তখন সােনার কাঠিটা ছোঁয়াতেই অবাক কাণ্ড! রাজকন্যা চোখ মেলে তাকাল। তাকিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল, “কে! কে তুমি?” রাজপুত্র নিজের পরিচয় দিল।
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 5
রাজকন্যা বলল, তুমি এখানে কী করে এলে?"
রাজপুত্র সে কথাও খুলে বলল রাজকন্যাকে। রাজকন্যা বলল, "তোমার নাম?" "আমার নাম দুধকুমার। তােমার নাম?”
“আমার নাম চম্পাবতী।” "তুমি কত সুন্দর।
“তুমিও;
“আমি তােমাকে বিয়ে করতে চাই।”
আমিও।"
আনন্দে দুজনে দুজনের হাত ধরল।
রাজপুত্র বলল, কিন্তু তুমি এইখানে এইভাবে শুয়ে আছে,একা একা তােমার
ভয় করে না?”
রাজকন্যা বলল, “আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
আমি তােমাকে এখুনি এখান থেকে নিয়ে পালাবো।”
পারবে না।
“কেন পারব না চম্পাবতী?”
তা হলে শােন, আমি চম্পানগরের রাজকন্যা। আমার মা, বাবা, এবং রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের চিবিয়ে খেয়ে এক রাক্ষসী আমাকে এই পাতালপুরীতে এনে লুকিয়ে রেখেছে। আর আমাদের সেই চম্পানগরকে করে রেখেছে এক বিশাল মরুভূমি। এই রাক্ষসীরা দুই বােন।
ছােট বোনকে সেইখানে রেখে নিজে এই পাতালপুরীতে বাস করেছে। কেন জানিনা রাক্ষসীরা আমাকে ভালবেসে ফেলেছে খুব। তাই আমাকে ওরা মারেনি। সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। ওই রূপার কাঠি আমার গায়ে ছোঁয়ালেই আমি ঘুমিয়ে পড়ব। আবার সোনার কাঠির ছোঁয়া পেলে জেগে উঠব।”
আমি যদি ওই রাক্ষসীকে বধ করি?” ওরা অমর। ওদের নজর এড়িয়ে আমরা যেখানেই যাই না কেন ওরা
আমাদের ধরে ফেলবে।
“এদের কোনও সীমানার গণ্ডি দেওয়া নেই? “আছে। এই সমুদ্রটাই ওদের গণ্ডি। ওদের নজর এড়িয়ে সমুদ্র পার হতে
গেলেই ওরা জানতে পারবে। আর তখনই ধরে খেয়ে ফেলবে দুজনকে।
"তা হলে উপায়?”
“উপায় একটাই। তুমি আমাকে ছেড়ে এখান থেকে যেও না, রাক্ষসী রােজ
সকালে আমাকে রূপাের কাঠিতে ঘুম পাড়িয়ে চলে গেলে তুমি আমাকে জাগিয়ে তুলাে। আর সন্ধে হবার আগেই একটা গােপন জায়গায় লুকিয়ে থেকো।
রাজপুত্র বলল, "সেই ভালাে! এখন তো সবে দুপুর। রাক্ষসীর আসতে
অনেক দেরি। চলাে, তুমি আমাকে তােমাদের এখানকার সব কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে।”
“দিচ্ছি। তবে আজ কিন্তু রাক্ষসী তাড়াতাড়ি আসবে।
"কি করে জানলে? কিছু বলে গেছে বুঝি?”
“হ্যা। আসলে ও যখন রােজ চলে যায় তখন আমি ওকে জিজ্ঞেস করি কখন ফিরবে? তা ও যদি বলে তাড়াতাড়ি ফিরব তাহলে জানতে হবে সন্ধের আগেই
ফিরে আসবে।” যাইহােক, রাজপুত্র তাে রাজকন্যা পেয়ে খুশি। রাজকন্যাও রাজপুত্রকে পেয়ে খুব খুশি। এই পুরীর শেষ প্রান্তে পম্পা সরােবর নামে একটি সরােবর আছে।
তার পাশেই আছে একটি শিবমন্দির। রাজপুত্র রাজকন্যার নির্দেশমতাে সেই শিবমন্দিরে লুকিয়ে থাকে। সারা রাত লুকিয়ে থাকে আর সকালে রােদ উঠলেই রাজকন্যার
কাছে গিয়ে হাজির হয়। এইভাবেই দিনের পর দিন যায়।
রাজপুত্র তার দেশ ভুলে গেল। বাপ মা ভুলে গেল। আর রাজারাণীও মাঝে মাঝে আসেন সমুদ্রতীরে। বসে হা হুতাশ করে মনের দুঃখ মনে নিয়ে ফিরে যান। এই করতে করতে রাজপুত্রের আশা এক সময় মন থেকে মুছেই ফেলেন তারা।
এদিকে রাজকন্যা রাজপুত্রকে পেয়ে খুশি হলেও তার বাবা মা ঘরবাড়ির খোঁজ নেয়। নিতে নিতে একদিন বলে, “চলে যা আছে কপালে একবার পালিয়ে
শিকারের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী part 6
যাবার চেষ্টা করেই দেখি কী হয়। রাজপুত্র বলে, “খবরদার ও কাজ করতে যেও না। তার চেয়ে চলাে এই শিবমন্দিরে আমরা দুজনে মালা বদল করে বিয়ে করে নিই। আর তুমি নানান কৌশলে রাক্ষসীর কাছে থেকে জেনে নাও ওদের মরণের জাদুটা কী?”
রাজপুত্রের কথামতাে তাই হল। বাগানের চাপা ফুলের মালা গেথে শিবমন্দিরে মালা বদল করে একদিন রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল। তারপর একদিন সম্ধ্যেবেলা রাক্ষসী ফিরে এসে যখন শুয়েছে রাজকন্যা তখন তার পা টিপতে বসে গেল।
রাক্ষসী অবাক হয়ে বলল, "কী রে, কী হল! আজ হঠাৎ আমার ওপর এত দরদ কেন তাদের ?”
রাজকন্যা করল কী একটা বাটিতে নুনু জল নিয়ে বসেছিল। সেই জল দু'এক
ফোটা রাক্ষসীর পায়ে ফেল দিল। আর রাক্ষসী আঙুলে করে সেই জল একটু চেখে
দেখেই বলল, ওমা! তুই কাদছিস ? আমি এত সুখে রেখেছি তাতেও তাের কান্না?" সে বলে, সুখে রেখেছ। কিন্তু একদিন যদি মরে যাও আমাকে দেখবে কে? রাক্ষসী হা হা করে হেসে বলল, ওরে পাগলি। আমি হলাম রাক্ষসী! আমার কি মরণ আছে? আমি আর আমার বোন দুজনেই আমার?”
"বাঃ, তাই আবার হয় নাকি? অমন রাবণরাজাও মরে গেল আর তােমরা
তাে কোন ছার।” রাক্ষসী বলল, তবে শােন, আমরা মায়ের মুখে শুনেছিলাম রাবণ রাজা নাকি আমাদের মাসতুতাে দাদা। তা তারও মরণ হতাে না। যদি না তার মৃত্যুবাণ চুরি
যেত।
তা হলে আমার কোনও ভয় নেই তো?"
“কিসের ভয়? আমরা রাক্ষসী। আমাদের প্রাণ অন্য জায়গায় রাখা থাকে।”
তাই নাকি? তােমাদের প্রাণ কোথায় থাকে?” রাক্ষসী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সে কথা কাউকে বলতে নেই রে।
তবে তুই তাে আমার মেয়ের মতন। তােকে বলতে কোনও আপত্তি নেই, তাই বলছি। ওই যে আমাদের শিবমন্দিরটা। ওর পাশে তে পম্পা সরােবর। তা ওই
পম্পা সরােবরের জলে কেউ যদি এক ডুবে নীচে যায় তা হলে একটা সােনার কৌটো দেখতে পাবে। সেই কৌটোর ভেতরে একটা কালাে ভ্রমর আছে।
সেটাই হচ্ছে আমাদের প্রাণ। যদি কেউ ওই ভ্রমরটাকে এক কোপে কাটতে পারে তা হলেই আমরা মরে যাবাে। তা কাজ আর করবে কে? এই পাতালপুরীতে কেউ আসতেই পারবে না। ও কাজও করতে পারবে না। অতএব আমাদের মরণ হবে না।
রাজন্যা খুব খুশি হবার ভান দেখিয়ে বলল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। আমার যে কী ভয় হত।”
পরদিন সকালে রাক্ষসী চলে গেলে রাজপুত্র এল, তারপর সোনার কাঠির পরশে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে সব শুনেই লাফিয়ে উঠল সে বলল, এই কথা! আমি আজই ওদের শেষ করব। বলেই দেওয়ালে ঝােলান একটা তরােয়াল নিয়ে রাজকন্যা সহ চলল পম্পা সরােবরের দিকে। সরােবরের কাছে গিয়ে তরােয়াল উচিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল সরােবরের বুকে।
তারপর এক ডুবে নীচে গিয়েই পেয়ে গেল সােনার কৌটোটা। সােনার কৌটোর মধ্যে সত্যিই একটা ভ্রমর ছিল। রাজপুত্র যেই সেই ভ্রমরটাকে এক হাতে ঠিপে ধরছে অমনি তাে রাক্ষসীরা টের পেয়ে গেল সব। তারা দুইবােন তাদের মৃত্যু আসন্ন জেনে ভীষণ চিৎকার করতে করতে ছুটে এল সরােবরের কাছে।
কিন্তু এলে কি হবে? রাজপুত্র তখন এক কোপে ড্যাং করে দিয়েছে ভ্ৰমরটাকে। আর যেই না দেওয়া, রাক্ষসীরাও ড্যাং হয়ে গেল অমনি। দেখা গেল তারা দুই আধখানা হয়ে মরে পড়ে আছে। রাজপুত্র আর রাজকন্যার তখন সে কী আনন্দ। সেই মণির প্রভাবে তারা
আবার জল পার হয়ে ডাঙায় এল। পাতালপুরীর ধনরত্ন নিয়ে রাজ্যে ফিরে তা লাগিয়ে দিল সকলকে। রূপনগরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রাজারাণী আবার ঘটা করে রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিলেন। তারপর এক শুভদিনে রাজসিংহাসনে বসল।
মন্ত্রীপুত্রও অভিষিক্ত হল নতুন মন্ত্রীপদে। শুধু কোটালপুত্র ও সেনাপতি পুত্রদের জন্য একটু যা দুঃখ রয়ে গেল সকলের মনে।
No comments:
Post a Comment