Wednesday, September 9, 2020

নীলকমল আর লালকমল

 নীলকমল আর লালকমল


দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার



এক রাজার দুই রাণী; তাহার এক রাণী যে রাক্ষসী! কিন্তু, এই কথা কেহই জানে না।

দুই রাণীর দুই ছেলে, লক্ষ্মী মানুষ-রাণীর ছেলে কুসুম, আর রাক্ষসী-রাণীর ছেলে অজিত। অজিত কুসুম দুই ভাই গলাগলি। রাক্ষসী রাণীর মনে কাল, রাক্ষসী রাণীর মুখে লাল। রাক্ষসী কি তাহা দেখিতে পারে? কবে সতীনের ছেলের কচি কচি হাড়-মাংসে ঝােল অম্বল রাঁধিয়া খাইবে; -তা পেটের ছেলে সতীন-পুতের সাথে ছাড়ে না। রাগে রাক্ষসীর দাঁতে-দাঁতে কড় কড় পাঁচ পরান সর্ স। | যাে না পাইয়া রাক্ষসী ছুতোনাতা খোঁজে, চোখের দৃষ্টি দিয়া সতীনের রক্ত শােষে। দিন দণ্ড যাইতে না যাইতে লক্ষ্মী রাণী শষ্যা নিলেন।

তখন ঘােমটার আড়ে জিভ ল আনাচে কানাচে উঁকি। দুই দিনের দিন লক্ষ্মী রাণীর কাল হইল। রাজ্য শােকে ভাসিল। কেহ কিছু বুঝিল না। অজিতকে “সক্স, কুসুমকে "মরমর রাক্ষসী সতীন পুত্রকে তিন

ছত্রিশ গালি দেয়, আপন পুতকে ঠোনা মারিয়া খেদায়।

দাদাকে নিয়া গিয়া অজিত নিরালায় চোখের জল মুছায় দাদা, আর থাক, আর আমার মার কাছে যাব না। রাক্ষসী - মা'র কাছে আর কেহই যায় না! লােহার প্রাণ অজিত সব সয়; সােনার প্রাণ কুসুম ভাঙ্গিয়া পড়ে। দিনে দিনে কুসুম

শুকাইতে লাগিল।

রাণী দেখিল

কি! আপন পেটের পুত্র,

সে-ই হইল শত্রু ! রাণীর মনের আগুন জ্বলিয়া উঠিল।

এক রাত্রে রাজার হাতী সাকো হাতী মরিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া মরিল, গােয়ালে


গরু মরে ,-রাজা ফাঁপরে পড়িলেন।

পর রাত্রে রাজার ঘরে কাই মাই !!" চমকিয়া রাজা তরােয়াল নিয়া উঠিলেন। সোনার খাটে অজিত-কুসুম ঘুমায়; এক মস্ত রাক্ষস কুসুমকে ধরিয়া আনিল। রাক্ষসের হাতে কুসুম কাঠির পুতুল ! রাণী ছুটিয়া আসিয়া মাথার চুল ছিড়িয়া রাজার গায়ে মারিল, হাত নড়ে না, পা পড়ে না, রাজা বােকা হইয়া গেলেন। রাজার চোখের সামনে রাক্ষস কুসুমকে খাইতে লাগিল। রাজা চোখের জলে ভাসিয়া গেলেন, মুছিতে পারিলেন না। রাজার শরীর থরথর কাপে, রাজা বসিতে পারিলেন না! রাণী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

নীলকমল আর লালকমল



অজিতের ঘুম ভাঙ্গিল;

রাত যেন নিশে

মন যেন বিষে,

দাদা কাছে নাই কেন? অজিত ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখে, ঘর ছছ করিতেছে, রাণীর হাতে

বালা-কাকন ঝুম্ করিতেছে, -দাদাকে রাক্ষস খাইতেছে! গায়ের রােমে কাটা, চোখের পলক ভাঁটা, অজিত ছুটিয়া গিয়া রাক্ষসের মাথায় এক চড় মারিল। রাক্ষস আই আই করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া এক সোনার ডেলা পরিয়া পালাইয়া গেল।

রাণী দেখিল, পৃথিবী উল্টিয়ে পেটের ছেলে শত্রু হইয়াছে! রাণী মনের আগুনে জ্ঞান-দিশা হারাইয়া আপনার ছেলেকে মুড় মুড় করিয়া চিবাইয়া খাইল! রাণীর গলা দিয়া এক লােহার ডেলা গড়াইয়া পড়িল। রাণীর পা উছল, রাণীর চোখ উপর’, সোনার ডেলা লােহার ডেলা নিয়া

রাণী ছাদে উঠিল। ছাদে রাক্ষসের হাট। একদিকে বলে

হুম হুম খামারে খাবার। আর দিক বলে,

গুম্ গুম্ গ্রামদেশে যাবে।

“গ গ গুম, খস্ খস্ খাঃ!

রাণী বলিল

আমি হেঁথা থাকি, তোরা দেশে যাঃ!" রাজপুরীর চূড়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজার বুক কাপিয়া উঠিল;গাছপাথর মুচড়িয়া নদীর জল উছলিয়া রাক্ষসের ঝাক দেশে ছুটিল।

ঘরে গিয়া রাণীর গাজুলে; রাণী সােয়াস্তি পায় না। বাহিরে রাণীর মন ছনছন, বুক ক ; রাত আর পােহায় না।

না পারিয়া রানী আরাম-কাঠি জিরাম-কাঠি বাহির করিয়া পােড়াইয়া ফেলিল। তাহার পর, মায়া-মেঘে উঠিয়া নদীর ধারে এক বাঁশ-বনের তলে সােনার ডেলা, লােহার ডেলা পাতিয়া রাখিয়া, রাক্ষসী-রাণী, নিশ্চিন্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল। বাঁশের আগে যে কাক ডাকিল, ঝােপের আড়ে যে শিয়াল কাদিল, রাণী


তাহা শুনিতে পাইল না। পরদিন, রাতে হুলুস্থুল। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ে। জাঙ্গাল। রাক্ষসের দেশ ছাইয়া গিয়াছে, আর রক্ষা নাই। যখন সকলে শুনিল, রাজপুত্রদিগকেও খাইয়াছে, তখন জীবন্ত মানুষ দলে-দলে রাজ্যে ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।

রাজা বােকা হইয়া রহিলেন; রাজার রাজত্ব রাক্ষস ছাইয়া গেল। নদীর ধারে বাঁশের বন হাওয়ায় খেলে, বাতাসে দোলে। এক কৃষাণ সেই বনের বাঁশ কাটিল। বাঁশ চিরিয়া দেখে, দুই বাঁশের মধ্যে বড় বড় গােল দুই ডিম। সাপের ডিম, না হাঁসের ডিম। কৃষান ডিম ফেলিয়া দিল। অমনি, ডিম ভাঙ্গিয়া লাল নীল ডিম হইতে লাল নীল-রাজপুত্রের বাহির হইয়া, - মুকুট মাথে খােলা তরােয়াল হাতে রাজপুত্র শন্শন্ করিয়া রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেল!

ডরে কৃষাণ মূর্ছা গেল। যখন উঠিল, কৃষাণ দেখে, লাল ডিমের খােলস সােনা আর নীল ডিমের খােলস লােহা হইয়া পড়িয়া আছে! তখন লােহা দিয়া

কৃষাণ কাস্তে গড়াইল; সােনা দিয়া বউর পইচে, বাজু বানাইয়া দিল। চলিয়া চলিয়া জোড়া রাজপুত্র এক রাজার রাজ্যে আসিলেন। সে রাজ্যে বড় খোক্কসের ভয়। রাজা রােজ মন্ত্রী রাখেন, খােককসেরা সে মন্ত্রী খাইয়া যায় আর এক ঘর প্রজা খায়। রাজা নিয়ম করিয়াছেন, যে কোন জোড়া রাজপুত্র খােকস মারিতে পারিবে, জোড়া পরীর মত জোড়া রাজকন্যা আর তাহার রাজত্ব তাহারাই পাবে।কত জোড়া রাজপুত্র আসিয়া খােক্কসের পেটে গেল। কেহই খাস মারিতে পারে নাই; রাজকন্যাও পায় নাই, রাজ্যও পায় নাই। লালকমল আর নীলকমল জোড়া রাজপুত্র রাজার কাছে গিয়া বলিলেন, আসিয়াছি!” - "আমরা রাক্ষস খোক্ষস মারিতে আসিয়াছি

রাজার মনে একবার আশা একবার নিরাশা; শেষে বলিলেন, আচ্ছা।" নীলকমল আর লালকমল এক কুঠরীতে গিয়া, তরােয়াল খুলিয়া বসিয়া রহিলেন।

রাত্রি কদণ্ড হইল, কেহ আসিল না। রাত্রি আর ক'দণ্ড গেল, কেহ আসিল না। রাত্রি এক প্রহর হইল, তবু কেহ আসিল না।


তাহা শুনিতে পাইল না। পরদিন, রাতে হুলুস্থুল। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ে। জাঙ্গাল। রাক্ষসের দেশ ছাইয়া গিয়াছে, আর রক্ষা নাই। যখন সকলে শুনিল, রাজপুত্রদিগকেও খাইয়াছে, তখন জীবন্ত মানুষ দলে-দলে রাজ্যে ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।

রাজা বােকা হইয়া রহিলেন; রাজার রাজত্ব রাক্ষস ছাইয়া গেল। নদীর ধারে বাঁশের বন হাওয়ায় খেলে, বাতাসে দোলে। এক কৃষাণ সেই বনের বাঁশ কাটিল। বাঁশ চিরিয়া দেখে, দুই বাঁশের মধ্যে বড় বড় গােল দুই ডিম। সাপের ডিম, না হাঁসের ডিম। কৃষান ডিম ফেলিয়া দিল। অমনি, ডিম ভাঙ্গিয়া লাল নীল ডিম হইতে লাল নীল-রাজপুত্রের বাহির হইয়া, - মুকুট মাথে খােলা তরােয়াল হাতে রাজপুত্র শন্শন্ করিয়া রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেল!

ডরে কৃষাণ মূর্ছা গেল। যখন উঠিল, কৃষাণ দেখে, লাল ডিমের খােলস সােনা আর নীল ডিমের খােলস লােহা হইয়া পড়িয়া আছে! তখন লােহা দিয়া

কৃষাণ কাস্তে গড়াইল; সােনা দিয়া বউর পইচে, বাজু বানাইয়া দিল। চলিয়া চলিয়া জোড়া রাজপুত্র এক রাজার রাজ্যে আসিলেন। সে রাজ্যে বড় খোক্কসের ভয়। রাজা রােজ মন্ত্রী রাখেন, খােককসেরা সে মন্ত্রী খাইয়া যায় আর এক ঘর প্রজা খায়। রাজা নিয়ম করিয়াছেন, যে কোন জোড়া রাজপুত্র খােকস মারিতে পারিবে, জোড়া পরীর মত জোড়া রাজকন্যা আর তাহার রাজত্ব তাহারাই পাবে।কত জোড়া রাজপুত্র আসিয়া খােক্কসের পেটে গেল। কেহই খাস মারিতে পারে নাই; রাজকন্যাও পায় নাই, রাজ্যও পায় নাই। লালকমল আর নীলকমল জোড়া রাজপুত্র রাজার কাছে গিয়া বলিলেন, আসিয়াছি!” - "আমরা খাস মারিতে

রাজার মনে একবার আশা একবার নিরাশা; শেষে বলিলেন, আচ্ছা।" নীলকমল আর লালকমল এক কুঠরীতে গিয়া, তরােয়াল খুলিয়া বসিয়া রহিলেন।

রাত্রি কদণ্ড হইল, কেহ আসিল না। রাত্রি আর ক'দণ্ড গেল, কেহ আসিল না। রাত্রি এক প্রহর হইল, তবু কেহ আসিল না।




লােম পুড়িয়া গন্ধে ঘর ভরিল; খােক্কসেরা গো গো করিয়া ছুটিয়া পালাইল!

খানিক পরে খােক্কসেরা আবার আসিয়া বলিল, তোদের জিভ দেখিব। লাল, নীলের তরােয়ালখানা দুয়ারের ফাক দিয়া বাড়াইয়া দিলেন। বড় খােক্কস দুই হাতে তরােয়াল ধরিয়া, আর সকল খোক্কসকে বলিল, - এবার জিভ

ছিড়িব, তারা আমাকে ধরিয়া খুব জোরে টান্ন-ন।”

সকলে মিলিয়া খুব জোরে টানিল, আর তর ধার নেঙ্গা তরােয়ালে বড় খােক্কসের দুই হাত কাটিয়া কালো রক্তের বান ছুটিল! চেঁচাইয়া মেচাইয়া, সকল খাস ডিঙ্গাইয়া বড় খােক্কস পলাইয়া গেল।

অনেকক্ষণ পরে বড় খাস আবার কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল, -কেজারে, কে জাগে?"

কতক্ষণ খােক্কস আসে নাই, লালকমলের ঘুম পাইতেছিল; লালকমল ভুলে বলিয়া ফেলিলেন,

লালকমল জাগে আর

মুখের কথা মুখে, দুয়ার কবাট ভাঙ্গিয়া সকল খাস লালকমলের লাল ডাকিলেন "ভাই!"

উপর আসিয়া পড়িল। ঘিয়ের দীপ উল্টিয়া গেল, লালের মাথার মুকুট পড়িয়া গেল;

নীলকমল জাগিয়া দেখেন, - খােক্কস! গা- মােড়ামুড়ি দিয়া নীল

বলিলেন,

“আরামকাঠী জিরামকাটি, কে জাগিস্ রে ?

দ্যাখ তাে দুয়ারে মাের ঘুম ভাঙ্গে কে!”

নীলকমলের সাড়ায় আ-খোক্কস ছো-খোক্কস সকল খাস

আধমরা হইয়া

গেল।

নীলকমল উঠিয়া ঘিয়ের দীপ জ্বালিয়া দিয়া সব খাস কাটিয়া ফেলিলেন। সকলের বড় খাস্তা নীলকমলের হাতে পড়িয়া, যেন, গিরগিটীর ছা!

খাস মারিয়া হাত মুখ ধুইয়া দুই ভাইয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে লাগিলেন।

পরদিন রাজা গিয়া দেখেন, দুই রাজপুত্র রক্তজবার ফুল গালাগালি হইয়া ঘুমাইতেছেন; চারিদিক মরা খাস গাদা। দেখিয়া রাজা ধন্যধন্য করিলেন। রাজার রাজত্ব, জোড়া রাজকন্যা দুই ভাইয়ের হইল।



সেই যে রাক্ষসী-রাণী? রাজার পুরীতে হানা দিয়া বসিয়াছে তাে? আই রাক্ষস কাই রাক্ষস তার দুই দূত গিয়া খোক্ষসের মরণ-কথার খবর দিল। শুনিয়া রাক্ষসী- রাণী হাঁড়িমুখ ভারী করিয়া বুকে তিন চাপড় মারিয়া বলিল, "আই রে। কাই রে! আমি তাে আর নাই রে!

ছাই পেটের বিষ-বড়ি সাত জন্ম পরানের অরি

ঝাড়ে বংশে উচ্ছন্ন দিয়া আয়!” অমনি আই কাই, দুই সিপাইর মূর্তি ধরিয়া, নীলকমল লালকমলের রাজসভায় গিয়া বলিল, “বুকে খিল পিঠে খিল, রাক্ষসের মাথার তেল না হইলে তাে আমাদের রাজার ব্যারাম সারে না।” লালকমল নীলকমল কহিলেন, - "আচ্ছা, তেল আনিয়া দিব।”

নৃতা তরােয়াল ধার দিয়া, দুই ভাই রাক্ষসের দেশের উদ্দেশে চলিলেন। যাইতে যাইতে, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খুব বড় এক অশ্বথ গাছ, হায়রাণ হইয়া দুই ভাইয়ের অশ্বত্থ তলায় বসিলেন।

সেই অশ্বস্থ গাছে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী পাখির বাসা। বেঙ্গমী বেঙ্গমাকে বলিতেছে। আহা, এমন দয়াল কারা, দুফোটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!

শুনিয়া, লাল নীল বলিলেন, গাছের উপর কে কথা কয়? রক্ত আমরা দিতে পারি।

বেঙ্গমী আহা আহা করিল। বেঙ্গমা নীচে নামিয়া আসিল।

দুই ভাই আঙ্গুল চিরিয়া রক্ত দিলেন।

রক্ত নিয়া বেঙ্গমা বাসায় গেল; একটু পরে সোঁ সোঁ করিয়া দুই বেঙ্গম বাচ্চা নামিয়া আসিয়া বলিল,-“কে তােমরা রাজপুত্র আমাদের চোখ ফুটাইয়াছ? আমরা

তােমাদের কি কাজ করিব বল।” নীল লাল বললেন, আহা, তোমরা বেঁচে থাক; এখন আমাদের কোনই - কাজ নেই।”

বেঙ্গম-বাচ্চারা বলল,"আচ্ছা, তা তােমরা, যাইবে কোথায় চল, আমরা পিঠে করিয়া রাখিয়া আসি।”









দেখিতে দেখিতে ডাঙ্গা জাঙ্গাল, নদ-নদী, পাহাড় পর্বত, মেঘ আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, সকল ছাড়াইয়া, দুই রাজপুত্র পিঠে, বাচ্চারা হু হু করিয়া শূন্যে উড়িল! শূন্যে শূন্যে সাত দিন সাত রাত্রি উড়িয়া, আট দিনের দিন বাচ্চারা এক পাহাড়ের উপর নামিল। পাহাড়ের নীচে ময়দান, ময়দান ছাড়ালেই রাক্ষসের দেশ। নীলকমল গােটাকতক কলাই কুড়াইয়া লালকমলের কোঁচড় দিয়া বলিলেন, “লোহার কলাই চিবাইতে বলিলে এই কলাই চিবাই। নীল লাল আবার চলিতে লাগিলেন।

দুই ভাই ময়দান পার হইয়া আসিয়াছেন, আর,

হাউ! মাউ! কাউ! মনিষ্যির গন্ধ পাঁউ!!

ধরে ধরে খায়!!!"

করিতে করিতে পালে পালে অযুত-নিযুত রাক্ষস ছুটিয়া আসিতে লাগিল।

নীলকমল চেঁচাইয়া বলিলেন, – “আয় মা! আয় মা! আমরাই আসিয়াছি তােমার নীলকমল, কোলে করিয়া নিয়া যাও!”

“বটে বঁটে, থু থাম!" বলিয়া রাক্ষস দিকে থামাইয়া এই লম্বা হাত পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, ঝাকার জট কাপাইতে কাপাইতে, হাঁপাইয়া জটবিজটি' আয়ী বুড়ী আসিয়া নীলকমলকে কোলে নিয়া "আমার নীলু! আমার নতুন!” বলিয়া আদর করিতে লাগিল। আয়ের গায়ের গন্ধে নীলুর নারী উলটিয়া আসে। লাল কে দেখিয়া আয়ীবুড়ী বলিল, ও তার সঙ্গে কেঁ র্যা?

নীলু বলিলেন, -ও আমার ভাই লাল আয়ীমা, ভাই!

বুড়ী বলিলেন,

"তা কেন মনিষ্যি মানিয্যি গন্ধ পাই? আমার নানু ইয় তাে চিবিয়ে খা

লোহার কলাই।

বলিয়া বুড়ী হোঁৎ' করিয়া নাকের ভিতর হইতে পাঁচ গণ্ডা লােহার কলাই বাহির করিয়া লাল-নাতুকে খাইতে দিল। লাল তাে আগেই জানেন, চুপে চুপে লােহার কলাই কোঁচড় পুরিয়া, কোঁচড় সত্যিকার কলাই কটু কটু করিয়া চিবালে। বুড়ী দেখিল, সত্যি তাে,





লাল টুকটুক নাতুই তাে। বুড়ী তখন গদগদ,দুই নাতু কোলে নিয়া বুলায়, ঢুলায়, কর-

"আইয়া মাইয়া নার্তুর

লালু নীলু কাতুর

নাটোর বালাই দূর যা!" - কিন্তু লালকমলের শরীরে মনুষ্যের গন্ধ! কোটের চোখ অগ, জিভ বার বার খসখস, আয়ীর মুখের সাত কলস লাল গোল! তা নাতু?- তাকি

খাওয়া যায়? বুড়ী কূয়ার মুখে লাডুটুকু খাইতে খাইতে খাইল না। শেষে নাতু নিয়া আয়ী বাড়ী গেল! সে কি পুরী!রাজ্যজোড়া। সেই ওসি অভিন্ পুরী রাক্ষস রাক্ষস কবি। যত রাক্ষসের পৃথিবী সাকিয়া জীবজন্তু মারিয়া অনিয়া পুরী ভরিয়া ফেলিয়েছে। লাল নীল, রাক্ষসের কাধে চড়িয়া বেড়ান আর দেখেন, - গাদায় গাদায় মরা, গাদায় গাদায় জরা! পচা, গলা পুরী দগ্ দগ্ থক্ থক্গন্ধে বারাে

ভুত পালায়, দেব দৈত্য ডরায়! দেখিয়া লাল বলিলেন, - "ভাই, পৃথিবী তাে

উজাড় হইল। নীল চুপ করিয়া রহিলেন, নাঃ, পৃথিবী আর থাকে না!'তখন নিশি রাত্রে,

যত নিশাচর রাক্ষস, সাত সমুদ্রের ঐ পারে যত রাজ-রাজ্য উজাড় দিতে গিয়াছে; এক কাচ্চা-বাচ্চা পুরীতে নাই;নীল কমল উঠিয়া, লালকমলকে নিয়া পুরীর দক্ষিন কূয়ার পাড়ে গেলেন। গিয়া, নীল বলিলেন,

-দাদা আমার কাপড়-চোপড় ধর।” কাপড় দিয়া নীলু, কূয়ােয় নামিয়া এক খড়গ আর এক সােনার কৌটা

তুলিলেন। কৌটা খুলিতেই জীয়নকাঠি মরণমাঠি দুই ভীমরুল ভীমরুলী বাহির হইল। জিয়ন কাঠি রাক্ষসের প্রাণ, আর মরণকাঠি যে, সেই রাক্ষসী রাণী প্রাণ। নীল

নিলেন জীয়নকাঠি, লাল নিলেন মরণকাঠি

জীয়নকাঠি মরণকাঠি ভীমরুল ভীমরুলীর গায়ে বাতাস লাগিতেই, মাথা কখন বুক চন্চন রাক্ষসের মাথার টন পড়িল; বােকা রাজার দেশে রাক্ষসী- রাণী ঘুমের চোখে ঢুলিয়া পড়িল।

মাথায় টন, বুকে চম; দীঘল দীঘল পায়ে রাক্ষসেরা নদী পর্বত এড়ায়, ধাইয়া ধাইয়া আসলে। দেখিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির পা দুটি ছিড়িয়া দিলেন। যত






রাক্ষসের দুই পা খসিয়া পড়িল। দুই হাত ভর, তবু রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসে নীলকমল জীয়নকাটির আর চার পা ছিড়িয়া ফেলিলেন। যত রাক্ষসের হাত খসিয়া পড়িল!

হাত নাই পা নাই, তবু রাক্ষস,

হাউ মাউ কাউ । সাত শত্রুর খাঁউ!!"

বলিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া ছােটে। খড়েগর ধারে ধরিয়া নীলকমল

জীয়নকাঠির মাথা কাটিলেন। আর যত রাক্ষসের মাথা ছুটিয়া পড়িল। আয়ীবুড়ীর

মাথাটা, -ছিটকাইয়া পড়িয়া নীল লাল কে ধরে-ধরে গিলে গিলে। তখন রাক্ষস-পুরী খাঁ-খা,আর কে থাকে? নীলকমল লালকমল আয়ীবুড়ীর নিয়া, বেঙ্গম,

মাথা নূতন কাপড়ে জড়াইয়া, মরণমাঠি ভীমরুলের সোনার কৌটা বেঙ্গম!” বলিয়া ডাক দিলেন।

তিন মাস তের রাত্রির পর দুই ভাইয়ের পা দেশে পড়িল। দেশের সকলে জয় জয় করিয়া উঠিল!

নীলকমল লালকমল বলিলেন, “সিপাইরা কৈ? ওষুধ নাও!" সিপাইরা কি আছে? আই আর কাই তাে রাক্ষস ছিল। তার সেইদিনই মরিয়াছে। নীলকমল আর লালকমল আপন সিপাই দিয়া বুকে খিল পিঠে খিল রাজার দেশে রাক্ষসের মাথা পাঠাইয়া দিলেন।

"ও-মা!! মাথা দেখিয়াই রাণী নিজ মূর্তি ধারণ করল

করম্ খাম গরম খাম

হুড়মুড়িয়ে হাজ্ডি খাম্। হম্ ধ ধম্ চিতার আগুন

বলিয়া রাক্ষসী-রাণী বিকট মূর্তি ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে নীলকমল-লালকমলের

রাজ্যে গিয়া উপস্থিত হইল।

বাহির দুয়ারে,-“খা! খা!!” লাল বলে,"থাম থাম।" লালকমল মরণকাঠি ভীমরুল আনিয়া 1.

কৌটা খুলিলেন।





গা ফুলিয়া ঢোল,

চোখের দৃষ্টি খােল, মরণকাঠি দেখিয়া, রাক্ষসী, মরিয়া, পড়িল গেল! সকলে আসিয়া দেখে, এটা আবার কি! খােক্কসের ঠাকুরমা না কি?

আমাদের রাজ্যে বুঝি নিমন্ত্রণ খাইতে আসিয়াছিল? সকলে “হাে- হাে- হাে!" করিয়া

উঠিল।

জল্লাদেরা আসিয়া মরা রাক্ষসীটাকে ফেলিয়া দিল। রাণী মরিল, আর বােকা রাজার রােগ সারিয়া গেল। ভাল হইয়া রাজা রাজ্যে রাজ্যে ঢােল দিলেন।

প্রজারা আসিয়া বলিল, "হায়! আমাদের সোনার রাজপুত্র অজিত কুসুম

রাজা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, হায়! অজিত কুসুম কৈ?”

এমন সময় রাজপুরীর বাহিরে ঢাক ঢোলের শব্দ। রাজা বললেন,দেখ

কৈ?

তাে, কি!” গলাগলি দুই রাজপুত্র আসিয়া রাজার পায়ে প্রণাম করিল। রাজা বললেন "তারা কি আমার অজিত কুসুম!”

প্রজারা সকলে বলল, "ইহারাই আমাদের অজিত কুসুম!” তখন দুই রাজা এক হইল;নীলকমল লালকমল ইলাবতী লীলাবতীকে লইয়া দুই রাজা সুখে কাল কাটাইতে লাগিলেন।


No comments:

Post a Comment

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...