বানর রাজপুত্র
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
এ ক রাজার সাত রানী, কিন্তু ছেলেপিলে একটিও নেই। রাজার তাতে বড়ই দুঃখ; তিনি সভায় গিয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকেন, কেউ এলে ভাল করে কথা
কন না।
একদিন হয়েছে কীএক মুনি রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মুনি রাজার মুখ ভার দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, 'রাজা তােমার মুখ যে ভার দেখছি; তােমার কিসের দুঃখ?”
রাজা বললেন, সে কথা কি বলব, মুনিঠাকুর ! আমার রাজ্য, ধন, লােকজন
সবই আছে, কিন্তু আমার যে ছেলেপিলে নেই, আমি মরলে এসব কে দেখবে? মুনি বললেন, এই কথা? আচ্ছা, তােমার কোনও চিন্তা নেই। কাল ভােরে উঠেই তুমি সােজাসােজি উত্তরে দিকে চলে যাবে। অনেক দূরে গিয়ে একটা বনের
ধারে দেখবে একটা আম গাছ রয়েছে। সেই আম গাছ থেকে সাতটি আম এনে তােমার সাত রানীকে বেটে খাইয়ে দিলেই তােমার সাতটি ছেলে হবে। কিন্তু খবরদার আম নিয়ে আসবার সময় পিছনের দিকে তাকিও না যেন। এই কথা বলে মুনি চলে গেলেন। তারপর দিন গেল, রাত হল, ক্রমে রাত ভাের হল। তখন রাজামশাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে সােজাসােজি উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে দেখলেন, সত্যি সত্যি বনের ধারে একটা আম গাছ আছে; তাতে পাকা পাকা সাতটি আমও দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে। সেই বনে তিনি কতবার শিকার করতে এসেছেন, কিন্তু আম গাছ কখনও
দেখতে পাননি। যা হােক, তিনি তাড়াতাড়ি সেইগাছে উঠে আম সাতটি পেড়ে নিয়ে
বাড়িতে ফিরে চললেন। খানিক দূরে যেতে যেতেই শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাকে ডাকছে, ওগাে রাজা, ফিরে চাও,
আরও আম নিয়ে যাও।
মুনি যে সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে কথা রাজার মনে ছিল না। তিনি পিছন থেকে ডাক শুনেই ফিরে তাকিয়েছেন, আর অমনি আম গুলো তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে আবার গাছে ঝুলতে লেগেছে। কাজেই রাজা মশাই-এর আবার গিয়ে গাছে উঠে আমগুলি পেড়ে আনতে হল। এবার আর তিনি কিছুতেই মুনির কথা ভুললেন না। তিনি চলে আসার সময় পিছনে কতরকম করে ডাকতে লাগল। চোর 'চোর বলে কত গাল দিল। রাজামশাই তাতে কান না দিয়ে বো বোঁ করে বাড়ির পানে ছুটলেন।
বাড়ি এসে রানীদের হাতে সাতটি আম দিয়ে রাজামশাই খেতে বললেন, তােমরা সাতজনে এই সাতটি আম বেটে খাও। ছােট রানী তখন সেখানে ছিলেন না। বড় রানীরা ছ'জনে মিলে তাকে কিছু না বলেই সব কটি আম খেয়ে ফেললেন। ছােট রানী এর কিছুই জানতে পারলেন না , কিন্তু তার ঝি সব দেখল। বড় রানীদের খাওয়া হয়ে গেল সে আমের ছালগুলি ধুয়ে বেটে ছােট রানীর হাতে দিয়ে বলল, 'মা, ওষুধটা খাও, তােমার ভাল হবে ওযুধ খেতে হয়, তাই ছােট রানী আর কোনাে কথা না বলেই সেটা খেয়ে ফেললেন।
তারপর বড় রানীদের সকলেরই এক একটি করে খােকা হল, রাজা তাতে খুশি হয়ে খুব ধুমধাম করে বাজনা করালেন। ছােট রানীরও একটি খােকা হল, কিন্তু সেটি হল বানর। বানর দেখে রাজা চটে গিয়ে ছােট রানীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দেশের লােকের তাতে বড়ই দুঃখ হল। তারা একটি কুঁড়েঘর বেঁধে ছােট রানীকে বলল, মা তুমি এইখানে থাক। সেইখানে ছােট রানী থাকেন। বানরটি সেখানে দিন দিন বড় হচ্ছে। সে মানুষের মত কথা কয়। আর এমনি বুদ্ধি যে, কোনও কথা তাকে শিকিয়ে দিতে হয় না
। যখন যে কাজের দরকার, অমনি সে করে। সারাদিন সে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, যেখানে যে ফল দেখে তা খায়; খুব ভাল লাগলে মার জন্য নিয়ে আসে। তাকে কেউ কিছু বলে না। কারুর গাছের ফল খেলে সে ভারি খুশি হয়ে ভাল ফল দেখিয়ে দেয়। তার বুদ্ধি দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়। এমনি করে দিন যাচ্ছে। বড় রানীদের ছটি ছেলেও এখন বড় হয়েছে। তারা বানরটিকে যারপরনাই হিংসা করে, সে তাদের সঙ্গে খেলা করতে গেলে তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়।
তারপর একদিন বানরটি দেখল যে, বড় রানীদের ছেলেদের জন্য মাস্টার এসেছে, তারা পুঁথি নিয়ে তার কাছে বসে পড়ে। তা দেখে বানর গিয়ে তার মাকে বলল, মা, আমাকে পুথি এনে দাও, আমি পড়ব। মা কাদতে কাদতে বললেন, 'হায় বাছা, কি করে পড়বে? তুমি যে বানর।'
বানর বলল, সত্যি মা, আমি পড়ব; তুমি বই এনে দিয়েই দেখ তিমি আমাকে
পড়াবে।
বানরের এমনি বুদ্ধি, যে বই পায় সে দুদিনে পড়ে শেষ করে ফেলে। সে দু'বছরে মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠল। বড় রানীদের ছেলেরা তখনও দু'তিনখানি বই পুঁথি শেষ করতে পারে নি; রােজ খালি মাস্টারের কাছে বকুনি খায়। এ-সব কথা শুনে রাজা একদিন বললেন, বটে? বানরের এমনি বুদ্ধি নিয়ে
এস কে তাকে, আমি দেখব।
বানরের কিছুতেই ভয় নেই; রাজা ডেকেছেন শুনে সে অমনি তার কাছে
উপস্থিত হল। তাকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে রাজার এমনি ভাল লাগল যে, তিনি
আর কিছুতেই ছােট রানীকে কুঁড়ে ঘরে ফেলে রাখতে পারলেন না। বাড়িতে আনতে ভরসা পেলেন না, পাছে বড় রানীরা কিছু বলেন। তাই তিনি রাজবাড়ির পাশেই একটি সুন্দর বাড়ি করে দিলেন। সেই বাড়িতে তখন থেকে ছােট রানী তাঁর বানর নিয়ে থাকেন। টাকাকড়ি যত লাগে রাজার লােক এসে দিয়ে যায়। লােকে তার বাড়িটাকে বলে বানরের বাড়ি। এসব দেখে বড় রানীদের ছেলেরা বানরকে আরও বেশি হিংসা করতে লাগল।
একটু-একটু করে ছেলেরা বড় হয়ে উঠল। সকলে রাজাকে বলল, রাজপুত্রেরা 1.
বড় হয়েছেন এঁদের বিয়ে দিন।
রাজা বললেন, তাদের দেশ বিদেশে ঘুরতে দাও। তারা নানান জায়গা দেখে, নানান রকম শিখে, টুকটুকে ছয়টি রাজকন্যা বিয়ে করে আনুক।
সকলে বলল, বেশ বেশ। তাই হােক। তারপর ছয় রাজপুত্র সেজেগুজে টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে ঘােড়ায় চড়ে নানান দেশ দেখতে বেরুল।
তা দেখে বানর তার মাকে গিয়ে বলল, 'মা আমিও যাব। তার মা বললেন, 'তুমি কী করতে যাবে যাদু, তােমাকে কোন্ টুকটুকে রাজকন্যা
বিয়ে করবে? তুমি যে দেশ দেখতে যাবে, আম তােমাকে ছেড়ে কি করে থাকব? বানর বলল, আমি দেখতে দেখতে ফিরে আসব। তােমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে যেতে দাও।
কাজেই ছােট রানী আর কি করেন? বানরকে যেতে দিতেই হল। ছয় রাজপুত্র ঘােড়ায় চড়ে যাচ্ছে; রাজবাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। একটা বনের ভিতর দিয়ে তাদের পথ, সেই পথ চলতে চলতে তাদের নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময়ে বনের ভিতর থেকে বানর এসে বলল, দাদা আমিও
এসেছি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল। তাতে রাজপুত্ররা যারপরনাই রেগে বলল, বটে রে, তাের এতবড় আস্পর্ধা।
আমরা রাজকন্যা বিয়ে করে আনতে যাচ্ছি বলে তুইও তাই করতে যাবি! দাড়া তােকে দেখাচ্ছি। এই বলে তারা বানরকে মারতে মারতে আধমরা করে একটা গাছে বেঁধে রেখে চলে গেল।
সেই বনে ছিল একদল ডাকাত। তারা দেখল যে, ছয় জন রাজ পুত্ররা ভারি সাজ করে টাকাকড়ি নিয়ে ঘােড়ায় যাচ্ছে। দেখেই তাে তারা মার-মার করে চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলল। রাজপুত্রেরা ভয়ে জড়সড় , তলােয়ার খুলবার কথা আর তাদের মনেই নেই। তাদের টাকাকড়ি, ঘােড়া, পােশাক, সবসুদ্ধ তাদের হাত পা বেঁধে নিয়ে যেতে ডাকাতদের দুই মিনিট সময় লাগল না। রাজপুত্রদের ধরে নিয়ে খানিকটা দূরে এসেই ডাকাতেরা দেখল, পথের ধারেই একটা বানর বাঁধা রয়েছে। তাকেও তারা সঙ্গে নিয়ে চলল। বানর যেন বেশ খুশি লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের সঙ্গে যেতে লাগল। তা দেখে ডাকাতেরা ভাবল, বুঝি কারু পােষা বানর, কাজেই তাকে আর তারা তেমন করে বাঁধল না।
সেই বনের ভিতরে ডাকাতের ঘর। সেই দিন তাদের বড় পরিশ্রম হয়ে ছিল, তাই রাজপুত্রদের নিয়ে সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে এসে বাঁধনসুদ্ধই ছ'টি ভাইকে একটি জায়গায় ফেলে রেখে তারা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন খুব করে নাক ডাকতে লেগেছে, তখনি বানর চুপিচুপি তার নিজের বাঁধন দাঁত দিয়ে কেটে তাতাতাড়ি গিয়ে রাজপুত্রদের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তখন আর তারা বানরকে ফেলে যাবে কোন লাজে? কাজেই তাকেও সঙ্গে করে, জিনিস পত্র নিয়ে, অমনি প্রাণপণে ছুট দিল, ডাকাতেরা কিছু টের পেল না।
ডাকাতদের ওখান থেকে পালিয়ে রাজপুত্ররা প্রাণপণে ঘােড়া ছুটিয়ে যেতে লাগল, ভােরের আগে তারা কোথাও থামল না। সকালে তারা দেখল যে তারা একটা ভারি চমঙ্কার শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে খুব বড় এক রাজার দেশ। তার বাড়ি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, যেন একটা ঝকঝকে সাদা পাহাড়। ছয় রাজপুত্র সেই বাড়ির কাছে গিয়েই টকটক করে ঘােড়া হাঁকিয়ে তার ভিতর ঢুকে পড়ল। দারােয়ানেরা তাদের পােশাক আর ঘােড়ার সাজ দেখে জড়সড় হয়ে তাদের সেলাম করল, আর কিছু বলল না। বানর কিন্তু জানে যে সে সেখানে
গেলেই তাকে ধরে ফেলবে; তাই সে রাজবাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে, খিড়কির
পুকুরের ধারে শুয়ে রইল।
সে দেশের রাজার সাত রানী। তাদের বড় ছজন ছিল ভারি হিংসুক আর দেখতে বিশ্রী, আর ছােটটি ছিলেন পরীর মত সুন্দরী আর বড় লক্ষ্মী। বড়রা রাজাকে মিছামিছিনানান কথা বলে ছােট রানীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; তিনি খিড়কির পুকুরের ধারে একটি কুঁড়ের মধ্যে থাকতেন, রাজা তার কোনও খবর নিতেন না। বড় ছয় রানীর ছয় মেয়ে ছিল, তারা দেখতে ছিলেন তাদের মায়ের মতন। আর তাদের মন ছিল তেমনি। আর ছােট রানীর যে মেয়েটি ছিল সেও তার মায়ের মতযেমন সুন্দরী, তেমনি লক্ষ্মী। তা হলে কী হয়, বড় রানীরা রাজাকে বুঝিয়ে
দিয়েছিল যে, ছােট রানীর মেয়েটা পাগল, কুঁজো, কানা, খােড়া, কালা আর বােবা। সেই খিড়কির পুকুর ধারে, সেই ছােট রানীর কুঁড়ে ঘরের কাছে বানর গিয়ে শুয়ে রয়েছে। খানিক বাদে বড় রানীদের ছয় মেয়ে ছটি ঘটি নিয়ে সেখানে স্নান করতে এল, ছােট রানীর মেয়েটিও তার ঘটিটি নিয়ে এল। তারা স্নান করে চলে আসবার সময় সেই মেয়েটির ঘটি থেকে কেমন করে খানিকটা জল বানরের গায়ে পড়ে গেল। অমনি বড় রানীদের ছয় মেয়ে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ওমা! ওমা! তােমরা দেখ এসেছােট রানীর মেয়ে বাঁদরটাকে বিয়ে করেছে। বড় রানীরাও শুনে ছুটে এসে বলতে লাগল, তাই তাে, ছােট রানীর মেয়ে বাঁদরটাকে বিয়ে করেছে!
সেই খবর তখনি তারা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। দেশের সকল লােক রাজার সভায় বসে শুনল যে, ছােট রানীর মেয়ের একটা বানরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। ছােট রানীর মনে যে কি কষ্ট হল, তা আর কী বলব? তিনি খাওয়া দাওয়া
ছেড়ে দিয়ে, মেয়েটিকে বুকে নিয়ে মাটিতে পড়ে কাদতেলাগলেন। তা দেখে বানর তাদের ঘরের দরজা থেকে হাত জোড় করে বলল, 'মা আপনি কাদবেন না। ভগবান যা করেন ভালই করেন; এ থেকেও আপনাদের ভাল হতে পারে। বানরকে মানুষের মত কথা কইতে দেখে রানী উঠে বসলেন। তার মনের দুঃখ যেন কোথায় চলে গেল; সেই থেকে বানর তাঁর ঘরের কাছে গাছের উপর থাকে আর প্রাণপণে তার সেবা করে। রানী যখন শুনলেন যে, সে রাজপুত্র, তখন সে যে বানর , সে কথা তিনি ভুলে গেলেন, তার মনে হল যে, এমন ভাল ও বুদ্ধিমান লােক আর মানুষের ভিতর নাই।
এদিকে হয়েছে কী, সেই ছয় রাজপুত্রও রাজার বাড়িতে ঢুকে একেবারে তার
সভায় এসে হাজির হয়েছে; রাজা দেখেই বুঝতে পেরেছেন, এরা রাজপুত্র। তিনি
জিজ্ঞাসা করলেন, 'বাপু, তােমরা কে? কি করতে এসেছ? তারপর যখন তাদের
বাপের নাম শুনলেন, আর শুনলেন যে তারা বিয়ে করার জন্য রাজকন্যা খুঁজতে
বেরিয়েছে তখন তাে তার খুশির সীমা রইল না। তিনি বললেন, বাঃ ! তােমরা যে আমার বন্ধুর ছেলে! বেশ হল; আমার ছয় মেয়েকে তােমরা ছ’জনে বিয়ে করবে। ঠিক অমনি সময়ে বাড়ির ভিতর থেকে খবর এল যে ছােট রানীর মেয়ের একটা বানরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। রাজপুত্ররা তখনি বুঝে নিল যে, এ আর কেউ নয়, তাদেরই বানর। তাদের মনে হিংসা হল যে বানর এসেই তাদের আগে রাজার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল। লােকে আবার কানাকানি করে বলে যে, সে মেয়ে নাকি রাজার আর ছয় মেয়ের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দরী আর ভালএসব কথা তারা যত ভাবে ততই হিংসায় জ্বলে মরে।
যা হােক, রাজার ছয় মেয়ের সঙ্গে তাে তাদের ছয় জনের বিয়ে হয়ে গেল, তারপর ঝকঝকে ময়ূরপঙ্খী সাজিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তারা বউ নিয়ে তাদের দেশে চলল। বানর ও একটি ছােট নৌকা করে তার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের পিছুপিছু চলেছে। তাকে দেখেই ছয় রাজপুত্র রেগে ভূত হয়ে গেছে আর ভেবেছে যে, একে বউ নিয়ে দেশে পৌঁছতে দেওয়া হবে না। মুখে কিন্তু ভাই, ভাই’ বলে ভারি আদর দেখাতে লাগল, যেন তাকে কতই না ভালবাসে। শেষে যখন বাড়ির কাছে এসেছে, তখন রাত্রে ঘুমের ভিতরে রেচারার হাত পা বেঁধে তাকে জলে ফেলে দিল। ভাগ্যিস ছােট বউ টের পেয়ে তাড়াতাড়ি একটা বালিশ ফেলে দিয়েছিল, আর তাই ধরে গরু
অনেক কষ্টে কোনও মতে ডাঙায় উঠল, নইলে সে যাত্রায় আর উপায় ছিল না। তারপর সকাল বেলায় নৌকা এসে ঘাটে লাগল। রাজা খবর পেয়ে ছেলে বউদের আদর করে ঘরে নিতে এলেন। ছয় ছেলে তাঁকে প্রণাম করল, রাজা তাদের
জিজ্ঞাসা করলেন, আমার বানর কৈ? তারা বলল, সে জলে ডুবে মারা গিয়েছে। বানর তাে মরে নি, সে নদীর ধারে ধারে তাদের আগেই ঘাটে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা সে জলে ডুবে মারা গেছে বলতেই বানর আড়াল
থেকে বেরিয়ে এসে রাজাকে প্রণাম করে বলল, আমি মরিনি বাবা, ওরা আমার এই বলে দুষ্ট ছেলেগুলিকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজা যারপরনাই আদরের সহিত
হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিল, আমি অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছি। তখন রাজপুত্রদের মুখ চুন। রাজা ভয়ানক রেগে বললেন, বটে! তােদের এই কাজ? দূর হ তােরা আমার দেশ থেকে; আর তােদের মুখ দেখব না।
বানর আর ছােট বউকে ঘরে নিয়ে এলেন। বানরের মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে আর সুন্দরী লক্ষ্মীবউ ঘরে এনে যে কত সুখী হলেন তা বুঝতেই পার। তারপর খুব সুখেই তাদের দিন কাটতে লাগল। এঁর মধ্যে হয়েছে কী, বউমা
দেখলেন যে, বানর শুধু দিনের বেলায় বানর সেজে বেড়ায়; রাত্রে সে বানরের ছাল খুলে ফেলে দেবতার মত সুন্দর মানুষ হয়। এ কথা তিনি ছোট রানীকে বললেন, ছােট রানী আবার রাজাকে জানালেন। রাজা তাে শুনে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললেন, বউমা, তুমি এক কাজ কর, আজ রাত্রে যখন সে বানরের ছাল খুলে ঘুমােবে, তখন তুমি সেই ছেলেকে পুড়িয়ে ফেলবে।
সেদিন বানরের শোবার ঘরের পাশের ঘরে মস্ত আগুন জ্বেলে রাখা হল, বানর তা জানতে পেল না। তারপর রাত্রে যেই ছাল খুলে রেখে সে ঘুমিয়েছে অমনি রাজকন্যা চুপি চুপি সেটাকে নিয়ে সেই আগুনে ফেলে দিয়েছে। সকালে বানর উঠে দেখে তার ছাল নেই। তখন সে ধরা পড়ে গিয়ে খুব ব্যস্ত হল, কিন্তু ব্যস্ত হয়ে কী হবে, আর বানর হবার জো নেই। দেখতে দেখতে সেই খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ল, আর ছেলেবুড়াে সকলে ছুটে এসে সব দেখে শুনে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল।
No comments:
Post a Comment