Wednesday, September 16, 2020

পাতাল পুরীর রাজকন্যা

 পাতাল পুরীর রাজকন্যা


কালিদাস ভদ্র

এ ক রাজপুত্র আর এক মন্ত্রীপুত্র দু’জনে ছিল খুব বন্ধু। এক সাথে তারা খেলতাে, বেড়াতাে। একদিন দুজনে দুটি পক্ষিরাজ ঘােড়া নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে এক গভীর বনে এসে পড়ল। 
বনের নিবিড় জঙ্গলে ঘন অন্ধকার আর অন্ধকার। কালাে অন্ধকারে দুজনেই পথ হারাল। বহু চেষ্টা করেও তারা বাইরে

যাওয়ার পথ চিনতে পারল না। মাঝে মাঝে শুধু বন কাপিয়ে হিংস্র জন্তুর ডাক শুনতে পেল। ভয়ে তাদের ভীষণ জল পিপাসা লাগল। ঘন কালাে অন্ধকার বনে জলের জন্যে মন ভারি ব্যাকুল

হয়ে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে সহসা ফোস ফোঁস শব্দে চমকে উঠলাে। মনে মনে তারা ভাবল শব্দটা কোনও সাপের। আর সাপের শব্দ পেয়ে ভাবল যে কাছাকাছি কোন

জলাশয় হয়তাে আছে। রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র দু'জনে পরামর্শ করে বনের একটা উঁচু গাছে চড়ে বসল। গাছের মাথায় উঠে মন্ত্রীপুত্র রাজপুত্রকে বলল, দেখ কুমার এখান থেকে বনের অনেক দূর পর্যন্ত বেশ দেখা যাচ্ছে। আর উঁচু থেকে সব কিছু কিন্তু ঝাপসা লাগছে না। 

জোনাকির আলােয় বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মন্ত্রীপুত্র আনন্দে চিৎকার করে উঠল, পেয়েছি। পেয়েছি। ঐ যে ঐখানে।

রাজপুত্র বলল, কী পেয়েছ? জল। ঐ যে জলাশয়।

রাজপুত্র আস্তে আস্তে মন্ত্রীপুত্রের কাছে যাওয়ার জন্য গাছের ডালটায় চড়ে

বসল।

দু'জনে গাছটার উঁচু ডালে বসে পরিষ্কার দেখতে পেল দূরে এক মস্ত সরােবর। সেই সরােবরের জলে বিশাল এক সাপ সাঁতার কাটছে। আর তার মাথা থেকে আলাে ঠিকরে পড়ছে। সেই আলােয় চারিদিক থই থই করছে। যেন আলাের বন্যায়


পাতাল পুরীর রাজকন্যা



সমস্ত বন তেসে যাচ্ছে। এত আলো দেখে দু’জনে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। মি গেল পিপাসা।

রাজপুত্রের বাকরুদ্ধ ভাব দেখে মন্ত্রীপুত্র বলল, দেখ কুমার সাপের মাথায় যা থেকে আলাে বের হচ্ছে, তা হল মণি। সাপের মণি। সাত রাজার ধন এক মানিক।

আর এই মণিটা পেলেই তুমি এখনই রাজা হবে। রাজপুত্র বলল, এখনই রাজা কি ভাবে হব।

হবে, হবে কুমার। রাজা এখনই হবে। সাপের মাথায় ঐ মণিটার অর্থ হচ্ছে এটা কোন রাজার রাজ্য। কোন কারণে হয়তাে রাজ্যটা গভীর অরণ্য হয়ে

আছে। নিশ্চয়ই কোন রাক্ষসের ষড়যন্ত্রে এমনটা ঘটছে। মন্ত্রীপুত্র আরও বলল, দেখ কুমার সাপের মাথার ঐ মণিটা আগে তােমাকে

উদ্ধার করতে হবে। আর ঐ মণিটা উদ্ধার করে তােমার হাতে আসলেই সব রহস্যের

জট খুলে যাবে।

গাছের মাথায় বসে দুজনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেখতে পেল সাপটা সরােবরের শান বাঁধানাে ঘাটের উপর উঠল। ডাঙ্গায় উঠে মাথার মণিটা ঘাটের সিঁড়ি শেষ ধাপে ফেলল। তারপর বন কাপিয়ে ফোস ফোস করতে করতে হারিয়ে গেল গভীর অরণ্যে। 

বেশ কিছুক্ষণ দু'জনেই হতবাক হয়ে বসে থেকে বুঝতে পারল যে সাপটা আর কাছে পিঠে নেই। হয়তাে খাবারের সন্ধানে দূরে কোথাও গেছে।

মণিটা নেওয়ার এমন সুযােগ আর আসবে না। তাড়াতাড়ি দুজনে গাছ থেকে নেমে পড়ল। আস্তে আস্তে খুব সাবধানে সরােবরের কাছে এসে দাঁড়ালো। 

শান বাঁধানো সিঁড়িতে নেমে রাজপুত্র মণিটা হাতে নিতেই আশ্চর্য হয়ে গেল। অবাক চোখে দেখল সরােবরের নীচে আশ্চর্য এক রাজপ্রাসাদ ঝলমল করছে। মন্ত্রীপুত্র রাজপ্রাসাদ দেখে ফিসফিস করে বলল,

কুমার মণিটা হাতে নিয়ে তুমি ডুব সাঁতারে ঐ প্রাসাদে চলে যাও। রাজপুত্র বলল,ভাই একা আমার যেতে ভীষণ ভয় করছে। তুমিও আমার

সাথে চল।

রাজপুত্রের কথায় মন্ত্রীপুত্র রাজকুমারকে জড়িয়ে ধরে সরােবরের জলে ডুব দিল। দুজনে এক ডুবে গিয়ে হাজির হল রাজপ্রসাদের সামনে। কী অপূর্ব প্রাসাদ! প্রাসাদের গায়ে অস্ত্র মণিমাণিক্য রচিত রয়েছে। তার গায়ে সাপের মণিটা থেকে



ঠিকরে পড়ে আলােয় ঝিকমিক করছে।

সাবধানে দুজনে প্রাসাদের ফটকদ্বার পেরিয়ে অন্দর মহলে এসে দাঁড়াল। শুনশান রাজপ্রাসাদে জনমানবের কেন সাড়া পাওয়া থাকে না। ভয়ে দুজনের বুক দুরু দুরু করছে। ভয় আর কৌতূহল এক অদ্ভুত রােমাঞ্চ তারা নুভব করছে। অনেকগুলাে ঘর পেরিয়ে শেষে একটি ঘরে এসে দুজনে বিস্মিত য়ে গেল। ঘরে এক অপূর্ব সোনার পালঙ্ক। 

পালঙ্ক থেকে নানান বর্ণালী রঙ ঘরময় ছাড়য়ে পড়ছে। আর সেই পালঙ্কে একটি অপূর্ব ফুটফুটে মেয়ে অঘােরে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটির লম্বা চুল পালঙ্ক থেকে নীচে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁচা হলুদ গায়ের রঙে ভারি সুন্দর মেয়েটিকে দেখে মন্ত্রীপুত্র বলল, এ নিশ্চয়ই এখানকার রাজকুমারী।

রাজপুত্র বলল, রাজকুমারী হােক আর যেই হােক, ওর ঘুম না ভাঙলে আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। মন্ত্রীপুত্র বলল, দেখ দেখ কুমার ওর পায়ের কাছে একটি সোনার কাঠি রয়েছে। নিশ্চয়ই ওই কাঠিতে কোন জাদু আছে। তুমি একবার ওই কাঠি ছুঁয়ে দেখতাে

কি হয়! রাজকুমার সােনার কাঠি ছোঁয়া মাত্র রাজকুমারী খিলখিল করে হেসে উঠে বসল বিছানার পরে। অবাক চোখে দুজনকে দেখে ভারি অবাক হয়ে গেল। অমনি মুহূর্তে মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। ভয়ার্ত গলায় কাপা কাপা স্বরে বলল, তােমরা কে গাে?

মন্ত্রীপুত্র সঙ্গে সঙ্গে বলল, ও হল রাজপুত্র। খুশখুশ দেশের রাজকুমার। আর আমি ওর বন্ধু। ওই দেশের মন্ত্রীপুত্র।

রাজপুত্রের পরিচয় পেয়ে রাজকুমারী আনন্দে কেঁদে ফেলল। কাদতে কাদতে বলল এটা পাতালপুর রাজ্য। আমার বাবা এখানকার রাজা ছিলেন।

 আর আমি তার একমাত্র কন্যা। রাজকুমারী রূপমতী। কিন্তু এক রাক্ষস একদিন হঠাৎ এসে এই রাজ্য দখল করে নেয়। 
আমার বাবা-মাকে আর সব প্রজাদের মায়া বলে সরোবরের উপর গাছ করে রেখে দিয়েছে। কেবল মাত্র আমাকেই একা সে এই রাজপ্রাসাদে রেখে দিয়েছে। যখন আহারের খোঁজে সে প্রাসাদ ছেড়ে যায় তখন সােনার কাঠি

দিয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে দেয়। রাজকুমারীর কথা শুনে রাজপুত্র জিন্তঞাসা করল,রাক্ষস টাকে দেখতে

কেমন?




রাজকুমারী বলল, প্রাসাদে যখন আসে তখন বুড়ির রূপ ধরে। আবার বাইরে যাওয়ার সময় বিরাট এক সাপের রূপ ধরে মাথায় এই রাজপ্রাসাদের মণিটা নিয়ে জল সাঁতরে ডাঙায় ওঠে। তার পর বনে বনে ঘুরে জীবজন্তু আহার করে।




মন্ত্রীপুত্র জিজ্ঞাসা করল—তুমি তাহলে কি খাও? রাজকুমারী বলল, সাপটা আসবার সময় মুখে করে একটা ফল নিয়ে

আসে। আর প্রাসাদে সেই ফলটা বুড়ি নিয়ে যখন আমায় দেয় তখন তার মায়াবী হাতের ছোঁয়ায় নানা রকম ফল হয়ে যায়। ওই ফল খেয়েই আমি ছয় বছর বেঁচে আছি।

রাজপুত্র বলল,আচ্ছা কুমারী তুমি কি জান কি ভাবে এই রাক্ষসকে হত্যা করা যাবে! আর কি ভাবে তােমাদের রাজ্য ফিরে পাবে। রাজকুমারী বলল, যা, কোনও রাজপুত্র যদি এখানে কোনদিন আসে তবে

সে পারবে আমাকে উদ্ধার করতে। আমি আমার বাবা-মাকে ফিরে পাব। আর সেই সাথে গােটা রাজ্য আবার আগের মত জেগে উঠবে। মন্ত্রীপুত্র বলল,এই তো রাজপুত্র এসেছে। 

তুমি বল কিভাবে তােমায় উদ্ধার রাজকুমারী বলল, এই প্রাসাদে আমার ঘরের নীচে যাওয়ার একটা সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে চোরাকুঠি যাওয়া যায়। 
সেইখানে একটা কাচের শিশিতে একটা কালাে ভ্রমর আছে। কুমার তরোয়ালের এক কোপে ভ্রমরটা কেটে ফেললে

করা যাবে।

রাক্ষসটা মারা যাবে। আর সেই রক্ত সরােবরের উপরে নিয়ে সবচেয়ে উঁচু গাছের

গায়ে ছিটিয়ে দিলে সমস্ত বন আবার নগর হয়ে যাবে। সাথে সাথে গাছগুলাে সব

মানুষের রূপ ধরে রাক্ষসের শাপ মুক্ত হবে। মন্ত্রীপুত্র রাজপুত্রকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোরা কুঠিতে হাজির হল। হাতে মণির আলােয় এককোণে কাচের শিশিটা চোখে পড়ল। খুব সাবধানে শিশিটার মুখ মন্ত্রীপুত্র খুলতেই কালাে ভােমরটা ভনভন করে বাইরে আসতেই রাজপুত্র ডানহাতে শক্ত করে তরােয়ালটা ধরে কোপ মারল। মুহূর্তে ভােমরাটা দুটুকরাে হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। 

সাথে -থে চারিদিক জুড়ে প্রকাণ্ড শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। শব্দ শুনে রাজকুমারী আনন্দে বলল-এই শােন রাক্ষসটার অট্টহাসি। যন্ত্রণায় ছটফট করার শব্দ। মরণ যন্ত্রণার গােঙানী।

রাজপুত্র এবারে ভােমরার রক্ত আস্তে আস্তে মাটি থেকে যতটুকু পারল তুলে একটা কাচের শিশিতে রাখল।

একহাতে শিশি আর এক হাতে মণিটা নিয়ে সরােবরের জল সাঁতরে ডাঙায় উঠল। সাথে সাথে মন্ত্রীপুত্র আর রাজকন্যা। রাজপুত্র সরােবরের পাশে সবচেয়ে উঁচু





গাছটার গায়ে সেই ভােমরার রক্ত ছিটিয়ে দিতেই গাছটা মানুষের রূপ ধরল। রাজকুমারী তাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে উঠতেই সমস্ত বন উধাও হয়ে গেল । 
অবাক হয়ে রাজপুত্র আর মন্ত্রী পুত্র দেখল সমস্ত বনটা যেন একটা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া ঝিকিঝিকি মাঠ হয়ে গেছে। চারিদিকে সব প্রজারা ঘুরছে। 

কেউ নাচছে, কেউ গাইছে। তাদের আনন্দধারার মধ্যে ঝলমল পাওয়ার মােড়া রানিমা চিৎকার করে বলেন,কই আমার সোনার ছেলে, রাজকুমার।

রাজকুমারী রাজপুত্রের সাথে রানির পরিচয় করিয়ে দিলেন। রানি আনন্দে রাজপুত্রকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, কুমার তুমি রাজকুমারীকে গ্রহণ কর। আজ থেকে রাজকুমারী রূপমতী তােমার দাসী। তােমার জন্য আমরা শাপমুক্ত হয়েছি। 

আজ থেকে তুমি আমাদের আত্মীয়। অতিথি। এই রাজ্যের অর্ধেক তােমার। তুমি সেখানকার রাজা হলে। ইচ্ছে হলে তুমি তােমার রাজ্যেও যেতে পার। চল কুমার, প্রাসাদে চল।

রাজপুত্র রাজা-রানীর সাথে এসে দাঁড়িয়ে ভারি অবাক হল। সরােবরে একটুও জল নেই। শান বাঁধানাে সিড়ি সােজা সরােবরের মধ্যে নেমে গেছে সেই রাজপ্রাসাদের দিকে।

রানি বলল, কুমার ঐ আমাদের প্রাসাদ। পাতালপুরী। চল ওখানেই তােমাদের

আজ বিয়ে হবে। পাতালপুরীতে মহা ধুমধাম করে রাজপুত্রের বিয়ে হল। বিয়ের পর রাজা

বললেন তােমাদের

পক্ষিরাজ ঘােড়াদুটোকে ডাক কুমার।

একটা পক্ষিরাজ ঘােড়ার পিঠ রাজপুত্র আর রাজকুমারী বসল। আর একটার

পিঠে মন্ত্রীপুত্র। রাজা সেই মণিটা শুধু রাজপুত্রকে যৌতুক দিয়ে বললেন, কুমার এটা আশ্চর্য মণি। যখনই যা ইচ্ছে, এই মণির কাছে চাইবে তাই পাবে। মণিটাকে সাবধানে কাছে কাছে রাখবে।

রাজপুত্র এবার মণিটাকে বলল, মণি তুই আগে আমার রাজ্যে পক্ষিরাজ ঘােড়াদের নিয়ে চল। অমনি হুশ শব্দে পক্ষিরাজ ঘােড়া দুটো উড়ে চলল খুশখুশ দেশে। 

বন, পাহাড় পেরিয়ে তারা উড়ে চলছে। নীচে পাতালপুরি থেকে উড়ে আসছে আনন্দ উৎসবের মুচ্ছনাসুর। খুশিতে রাজকুমারী রূপমতী তাদের হাত নেড়ে বিদায় অভিনন্দন জানাচ্ছে। রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র তাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাত নাড়ছে।

No comments:

Post a Comment

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...