Wednesday, September 9, 2020

রূপেশ্বরী রাজকন্যা

 রূপেশ্বরী রাজকন্যা


ইন্দিরা দেবী


মেয়ের রূপ দেখলে পথের লোক থমকে দাঁড়ায় দেখে দেখে যেন চোখে আশা মেটে না। এমন সুন্দরী মেয়ে, এমন নিখঁত গঠন, এমন চোখ, এমন মুখ, এত রূপ কেউ কখনও দেখে নি। রাজার গর্ব রাণীর মনেও অহঙ্কার—এমন সুন্দরী মেয়ে আর হয় না। ছােট থেকে সুন্দরী সুন্দরী শুনতে শুনতে রূপেশ্বরী মনে মনে এত অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিল যে কাউকে আর সুন্দর মনে হতাে না তার নিজের চেয়ে|




রূপের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই অনেক বিয়ের সম্বন্ধ ও আসছিল কিন্তু হলে কি হয়, পছন্দ আর হয় না। যদি রাজরাণীর 1. পছন্দ হলাে তাে রূপেশ্বরী রূপবা রাজপুত্রদের দেখেও মুখ বাঁকিয়ে বলে - মাগাে কি বিচ্ছিরী!



বিয়ে করার কথা ভুলে গিয়ে সেই সব ভিনদেশের রাজপুত্তুরেরা অপমান বােধ করে মনে মনে প্রতিশােধের সঙ্কল্প নিয়ে চলে যেতাে। দিন কেটে যায়। এমনি করে দিন যেতে যেতে বিয়ে আর হয় না। বয়স



বাড়াতে লাগলাে। রূপেশ্বরীর সঙ্গিনীদের এক এক করে সব বিয়ে হয়ে গেল। তারা যখন বাড়ি আসতাে রূপেশ্বরীর সঙ্গে রাজবাড়িতে দেখা করতে এসে বলতাে ? ওমা, রূপাে তাের এখনও বিয়ে হলাে না?



রূপেশ্বরীর মুখ লাল হয়ে উঠতাে। সঙ্গিনীরা বুঝতে পারতাে কথাটা বলা ভালাে হয় নি তাদের। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলতাে, কবে করবে বলে রাখ। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে আসবাে।



আমরা রূপেশ্বরীর মনে যাই থাকুক, মুখে বলতাে : হ্যাঁরে হ্যা, পাঠাবাে তাদের লাল চিঠি। আমার চেয়ে সুন্দর বর পেলে বিয়ে করবাে। রাজার বয়স হয়েছে রাণীরও





তাই। চোখে দৃষ্টি কমে যাচ্ছে, ছেলে নেই, রূপেশ্বরীই একমাত্র মেয়ে। তার বিয়ে দেবেন, জামাই এলে তাকেই সিংহাসনে বসাবো রাজত্ব দেবেন। সেই কথায় বলে—অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা। এ আবার অর্ধেক নয় পুরােই। এতদিন পর্যন্ত যে-সব রাজপুত্ররা ফিরে গেছে তাদের অপমানের কথা তারা তাে এত শীঘ্র ভুলে যায় নি। এদিকে হলাে কি, আর কেউই আসে না সুন্দরী মেয়ে রূপেশ্বরীর


Rupeswri RajKanna



খোঁজে। রাজবাড়ির ব্যাপার তার উপর স্বয়ং রাজকন্যার বর নির্বাচন; যখন কিছুতেই আর হলাে না, প্রজারা সবাই বলাবলি করতে লাগলাে। রাজা রাণী, রূপেশ্বরী কেউ সে আলােচনা থেকে বাদ গেল না। সব কথাই রাজার কানে আসতে লাগলাে। মনে মনে ভীষণ রেগে গেলেও কথাটা যে ঠিক এই কথা রাজা মনে মনে জানতেন। একদিন রাজা রাণীকে বললেন দেখ, এখনও যদি রূপে মন ঠিক করে কাউকে বিয়ে না করে, তাহলে আমি নিজে এবার এ বিয়ের ব্যবস্থা করবাে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে, তারপর এই রাজ্যের কি হবে? সুন্দরী মেয়ে বলে সারা জীবন কেটে যাবে




বিয়ে হবে না! আর একবার বরং শেষ বারের মতাে চেষ্টা কর। যাতে ভিনদেশের রাজার ছেলে এসে বিয়ে করে আর তা যদি না হয় তাহলে আমার য়া মনে আছে—আমি করবােই। রাণীরও মনের কথা তাই। কিন্তু আদরের সুন্দরী মেয়ে ছােটবেলা থেকে অন্যায় আদরে যার স্বভাব বিপরীত হয়ে গেছে তাকে আর এখন সংশােধন করা যাবে কেমন করে। তাই মেয়েকে বললেন দেখ বাছা, এবার একটা বিয়ে থা করে নাও। রাজার বয়স হয়ে যাচ্ছে আমারও ভাল লাগছে না। তােমারও বয়স কম হলাে না!সুন্দরের অহঙ্কার ছাড়াে। রূপেশ্বরীর রূপের গর্ব আর কি সহজে যায়। বললে, মনের মতাে না হলে, আমার চেয়ে সুন্দর না হলে বিয়ে করবাে কি করে? তাহলে ঐ যে রাখাল গােরু নিয়ে যায় তাকে বিয়ে করলেই হয়! রাণী মেয়ের কথায় খুবই রেগে গেলেনমনে মনে বললেন, অদৃষ্টে তােমার তাই আছে হয়তাে, অহঙ্কারের সীমা নেই তােমার।



রাজার আদেশে রূপেশ্বরীর বিয়ের জন্য আবার স্বয়ংবর-সভা ডাকা হলাে। দেশ-বিদেশে খবর গেল। বাইরে টেরা দেওয়া হলাে। চারিদিকে লােক ছুটলাে দেশ দেশান্তর থেকে, যাতে রাজার ছেলেরা আসে। অনেক চিঠিপত্র খবরাখবর এলাে। রাজা রাণীকে সত্র্ক করে দিয়ে বললেন, এই সভা যেন পণ্ড না হয়। তা যদি হয় তাহলে আমি কাল সকালে উঠে যার মুখ দেখবাে তার হাতেই মেয়ে দেবাে। রূপেশ্বরীর কানেও কথা গেল। সুন্দর করে সাজানাে ভারতে যাবার জন্য নিজেও সুন্দর করে সেজে রইল। মনে মনে কিন্তু সে ভেবেই ছিল যে তার চেয়ে




সুন্দর না হলে গলায় মালা দেবে না। কিন্তু কি হলাে! রাজপুত্তুর এমন কি মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র দেখা নেই! অপেক্ষা করে করে সন্ধ্যা নেমে এলাে, সভা সাজানাে, বাজনা বাজানাে সব বৃথা গেল; রাগে দুঃখে লজ্জায় রাজা পাগলের মতাে হয়ে উঠলেন। অপমানে, লজ্জায় রূপেশ্বরীর মুখ কালাে হয়ে গেল।



সমস্ত উৎসব আয়ােজন পণ্ড হয়ে গেল। রাজা অন্দরমহলে এসে রাগে ফেটে পড়ে রাণীকে বললেন, কাল সকালে উঠে আমি যার মুখ দেখবাে তার সঙ্গেই রূপাের বিয়ে দেবাে।



রাণী জানেন রাজার কথা নড়চড় হবার নয়। কি করবেন ভেবে না পেয়ে সারারাত জেগে কাটালেন। ভোরবেলা জানলা দিয়ে রাজা দেখছেন ঘুম থেকে




উঠছেন কিনা। ওমা! কোন সকালে উঠে রাজা শােবার ঘরের সামনে অলিন্দায় বসে আছেন, ভাল করে তখন ফরসাও হয় নি। ভয়ে রাণীর মুখ শুকিয়ে উঠলাে। মুখ ফিরিয়ে পথের দিকে তাকাতেই দেখলেন রাখাল একদল গােরু নিয়ে মাঠে চলছে। রাজা উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ইঙ্গিতে তাকে ডাকলেন। রাখাল অনেক দূর দিয়ে যাচ্ছিল। বুঝতেই পারছিল না তাকে কেউ ডাকছে। তাছাড়া রাজপ্রাসাদ থেকে তার ডাক আসতে পারে এমন চিন্তা তার হবেই বা কি করে! তাই আপন মনে চলছিল গােরুর পাল তাড়াতে তাড়াতে। বেশ খানিক দূর এগিয়ে গেছে এমন সময় মনে হলাে কে যেন তাকে থামতে বলছে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলাে একদল লােক আসছে। তাদের পােশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হলাে রাজবাড়ির লােক। রাখাল থমকে দাড়ালা। তারা কাছে এসে নমস্কার করে বললে, রাজামশাই ডাকছেন।


রাখাল ভয়ে থ হয়ে গেছে। কেন রে বাবা! আমি তাে কিছু করি নি! কিন্তু সোনা মুক্তা মােড়া পাল্কিতে যখন


যেতে হবেই কথা বলে লাভ নেই। লােকরা একটা পান্কি এনেছিলসুন্দর


তাকে উঠতে বলা হলােতখন আরাে ভয় পেয়ে গেল রাখাল। বাড়ির কথা মা'র


কথা মনে হতে লাগলাে।

রাজার অনুচরেরা তাকে সমে পালকিতে উঠিয়ে নিয়ে একেবারে রাজপ্রাসাদে
চলে এলাে। সব শুনে রাখাল তাে অবাক! সে ভীত হয়ে পড়লাে আরাে! সকালবেলাই এ কি কাণ্ড!


অন্দরমহলে তখন রাণী চোখ মুছছেন, রূপেশ্বরী রাগে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে


আছে। কবে কুক্ষণে মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়েছিল রাখালের সঙ্গে তার বিয়ে হলেই

হয়। সকলেরই মুখ বিষাদ-গম্ভীর। কিন্তু তবু বিয়ে হবে রাজার কথার নড়চড় হবে না। কিন্তু এতক্ষণে রাখালের মুখ খুলছে। সে রাজাকে সবিনয়ে বললে, আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, তবে আমার কিছু কথা আছে তা আপনাকে রাখতেই হবে। রাজা বললেন, নিশ্চয়ই। বলাে তােমার কি কথা? রাখাল বললে, বিয়ের পর আমি বউ নিয়ে আমার বাড়ি যাবাে। আমার মা আছেন, ভাইবােনরা আছে। তাছাড়া আমার স্ত্রী যে হবে সে আমার বাড়ি গিয়ে থাকবে। রাজা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিয়েটা তিনি নিতান্ত রাগের বশে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু



তাই বলে রূপাে গিয়ে একটা রাখলের কুটিরে বাস করবে কি করে? যেখানে নােংরা ময়লা, গােরু গােবরে ভরা, যে বাড়ির লােকেরা খেতে পায় না! রাজা বললেন, কিন্তু


রাখাল দৃঢ় কণ্ঠে বললে, কোন কিন্তু তাে নেই মহারাজ। এই তাে নিয়ম।


কিন্তু আমি জামাইকে শুধু কন্যা দান করবাে তা তাে নয়? এই রাজত্ব,


প্রাসাদ, সিংহাসন সবই তাকে দেবাে। আমার ছেলে নেই; তাই আমি জামাইকে রাজা করবাে। কাজেই সকলকে এখানেই থাকতে হবে। তােমার বাড়িতে যারা আছেন—মা, ভাই-বােন সবাইকে নিয়ে এসাে এখানে।


রাখাল বললে, ভবিষ্যতে কি হবে তা আমি এখনই কথা দিতে পারছি না


আপনাকে কিন্তু এখন বিয়ের পরই আমার স্ত্রীকে আমার বাড়ি যেতে হবে। সিংহাসন দেওয়াটা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু যে নেবে তারও তাে একটা ইচ্ছা আছে?


রাজা অবাক, বলে কি একটা রাখাল ছেলে। সিংহাসন, রাজ্য, রাজকন্যার কিছুতেই তার লােভ নেই। আর যে-সব কথা সে বলেছে, যুক্তির দিক থেকে


একটাকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাখালকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাখালের কথার নড়চড় নেই। রাজঅন্তঃপুরে কথাটা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়লাে। রাণী হাউ হাউ করে কেঁদে


উঠলেন বিয়েটা পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন নিরুপায় হয়ে আবার রূপাে যাবে গােয়াল ঘরে বাস করতে? রাখাল ছেলেটার স্পর্ধা তাে কম নয়! এ কিছুতেই হবে ! বলে কি দেখ! ঘুটে কুড়োনির ব্যাটা পদ্মলােচন! এত সুখ কপালে কোন কালে হতাে? গােরু আর গােবরে তাে মানুষ! পেটে অন্ন জোটে না।


ঠিক এইরকম চিন্তা হচ্ছিল রূপেশ্বরীর মনের মধ্যে এই ছিল অদৃষ্টে! জুটলাে একটি রাখাল, আর থাকতে হবে গিয়ে গোরু আর গােবরের মধ্যে কুঁড়েঘরে? বাবা রাগের মাথায় একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছেন তাই বিয়ে হবে। কিন্তু ঐ লােকটা থাকবে চাকরদের ঘরে, আমি যেমন আছি তেমনি থাকবাে। রাগে দুঃখে রূপেশ্বরীর মুখ আগুনের মত হয়ে উঠলাে। গায়ের গয়না ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাে, চন্দন মুছে ফেললাে, বেনারসী খানা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললাে। যে কাছে এসে কিছু বলতে যাচ্ছে, তাকেই প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিচ্ছে।


সন্ধ্যাবেলায় নহবৎ বাজলা শাঁক উলুর শব্দ শোনা গেল—বিয়ে হয়ে



গেল। রূপেশ্বরী তাকিয়ে দেখলাে না একবার। গলার মালা দেবার সময় চোখ বন্ধ করে রইল সে।


পরের দিন সকালবেলা রাখাল বলে, চল গে রাজকন্যে আমার ঘরে। ওসব কাপড়চোপড় ছাড়াে। ওখানে গিয়ে মার সঙ্গে ঘুঁটে দিতে হবে, গােয়াল পরিষ্কার করতে হবে। তাই ওসব পড়ে না যাওয়াই ভালাে। চল চল এতক্ষণ আমার গােরুগুলাে কোথায় এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়লাে একটা দিনরাত তােমাদের বাড়িতে আমি বন্ধ রইলাম। আমার মা কিছু জানে না। আমার জন্য তার সইয়ের মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে বিয়ে দেবে বলে। ফুলকুমারী মেয়েটা খুব কাজের কিনা! সেইজন্য মা'র ভারি পছন্দ তাকে। তােমায় নিয়ে যাবাে, আর কাল থেকে আমি বাড়িতে নেই, মা যে কত রাগ করবে তাই ভাবছি। তা দেখ, আমার সঙ্গে তুমি ওখানে গিয়েই মাকে প্রণাম করাে, আর গােবরের বাতি, খড়কুটো সব নিয়ে নিও। একটু কাজকর্ম করলেই মা খুশী হবে। তােমার তাে আবার অভ্যেস নেই তাই বলে দিচ্ছি।


রাণী দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন বলে উঠলেন, কি বলছাে তুমি? আর কাকে বলছে জানাে? আমার মেয়ে গিয়ে গােবর দেবে আর কাজ করবে? তুমি একাই যাও এখান থেকে। আমার মেয়ে যাবে না।


রাখাল বেশ শান্ত গলায় বললে, আপনি বললে তো হবে না, রাজামশাই - এর সঙ্গে আমার সব কথা হয়ে গেছে। কাজেই আপনার মেয়েকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে, আর আমরা তাে গরীব লােকগােরু, গােবর নিয়ে কারবার। তাই কাজ তাে করতেই হবে ঐ সব নিয়ে। আর দেরি করে লাভ নেই। আমার মা খুব


ভাবছে। কাল থেকে আমি বাড়ি ছাড়া। রাজামশাই এসে একটু বােঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু বৃথা। এসব কথা তাে কালই হয়ে গেঞ্জি।


কাদতে কাদতে রূপেশ্বরীকে পানিতে উঠতে হলে। রাখাল বললে, এটুকু পথ তুমি হেঁটে যেতে পারবে না? তবে পাল্কিতে চলাে। কিন্তু একটু আগেই নেমে পড়াে, পান্কি দেখলে মা আবার রেগে যাবে কিন্তু। আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে কাজ করি। এদিক-ওদিক যাই। ওদিকে রাণী যত কাদেন এদিকে রূপেশ্বরী তত কাদে। ওদের কান্নায় রাজারও মন খারাপ। ঘটনাচক্রে যাই ঘটুক, রূপেশ্বরী যে আদরের



মেয়ে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

পাকি করেই রূপেশ্বরী গেল আর রাখাল তার নিজের আধ ময়লা পােশাক পরে পান্কির সঙ্গে সঙ্গে চললাে। লােকজন সঙ্গে নিতে দেয়নি—শুধু বাহকরা যাচ্ছে। পথ আর ফুরােয় না। দুঃখের পথ দীর্ঘ হয়, সে কথা আজ রূপেশ্বরীর বেশি করে মনে হলাে যেন। কত লােকের মনে কষ্ট দিয়েছে, অহঙ্কার মানুষের কত সর্বনাশ করে সে কথা বারে বারে মনে হতে লাগলাে তার। একটা খড়ের ঘরের সামনে এসে পানি থামলে রাখাল বললে, তােমরা এবার চলে যাও। রাজকন্যা নেমে আসুক।

ঘরের অবস্থা দেখে পালকি-বেহারা অবাক! রাজার বাড়ির দাস দাসী। এর চেয়ে ভাল ঘরে থাকে আর রাজকন্যা কিনা এই বাড়িতে থাকবে! কি কাণ্ড! অবাক হয়ে সব মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাে। এমন সময় এক বাতি গােবর নিয়ে-হাঁটুর উপর কাপড় তােলা, হাত-পা ময়লা একজন স্ত্রীলােক এসে বললে, কাল থেকে কোথায় ছিলি রে! গােরু-বাছুর নিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। কোন্টা কম্নে চলে গেল তার ঠিক নেইকি ব্যাপারটা কি?

বিয়ে হলাে যে! —বিয়ে! কার ?


আমার। ঐ তাে পাল্কির মধ্যে বউ রয়েছে।


বউ! বিস্ময়ে আকাশপানে হাঁ করে রাখালের মা বললে, তাহলে ফুলকুমারীর কি হবে? সইকে আমি কি বলবাে? গরু-বাছুর চড়াতে গিয়ে বিয়ে করে এসেছ? চালাকী করার জায়গা পাও নি!যাও শীগগির গােয়ালে! বিয়ের মজা দেখাচ্ছি। ওটা কে মেয়েটা?


রাজার মেয়ে। সকালে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিলে। তুই বললি না কেন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? এখন এই বউটাকে নিয়ে আমি করবাে কি? রাখাল বললে, কাজকর্ম করবে। রাতে তামার পায়ে হাত বুলিয়ে দেবে।

ওসব কথা শুনতে চাই না। ওটাকে কোথা থেকে এনেছিস এখুনি বিদেয় করে দে। ঝঙ্কার দিয়ে উঠলাে রাখালের মা।।

রাখাল বললে, বিয়ে করে এনেছি, বিয়ে করবাে কি করে! রূপেশ্বরীর মরে যেতে ইচ্ছা করছে একথা শুনে। তবু ভাবছে রাখাল যেন তার মা'র কথা শুনে এখনি বিদায় দেয়তাহলে সে যেন বাচে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার





কিন্তু হলাে না। তাকে নামতেই হলাে। পান্কি-বেহারারা মলিন মুখে চলে গেল আর মাথা হেঁট করে রূপেশ্বরী সেই কুটীরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে কি করবে কোথায় দাঁড়াবে ভেবে পায় না। কটা ছেলে মেয়ে প্রায় অর্ধ উলঙ্গএসে বললে, তুমি রাজকন্যে! আমাদের বাড়ি এসেছ বৌদি হয়ে!

তাহলে চল রান্না করে খেতে দেবে। সাজ-পােশাক ছেড়ে তাদের সঙ্গে রান্না ঘরে গিয়ে রূপেশ্বরীর আরাে কান্না পেতে লাগলাে। এই রান্নাঘর, এই খাবার-দাবার!

কিন্তু যেখানে যাচ্ছে সেখানেই তাই! ময়লা ছেঁড়া কাঁথায় শুতে গিয়ে বমি আসতে লাগলাে। রাখাল বললে, এখনি শুয়ে পড়লে কেন? আমার মা সারাদিন খাটছে। গােরু-বাছুর-গােবর নিয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বড় কষ্ট, যাও তুমি গিয়ে একটু পা টিপে দাও। রূপেশ্বরী চিৎকার করে উঠলাে, না, না আমি পারবাে না। এই ক’ঘণ্টাতে আমি আধমরা হয়ে গেছি। ঐ নােংরা পায়ে হাত দিয়ে আর আমি থাকতে


চাই নে। এখনি আমায় পাঠিয়ে দাও আমার বাপের বাড়ি। রাখালের গলার আওয়াজ তেমনি নরম। বললে, তা কি করে হবে, তােমার


বাবা আমাকে ডেকে বিয়ে দিয়েছেন—মেয়ে দান করে দিয়েছেন, কি করে আমি


তােমায় পাঠিয়ে দেবাে বল? যাও যাও আর কথা বাড়িও না, মা'র কাছে যাও মা একেই ফুলকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিতে পারে নি বলে রেগে আছে। । অগত্যা কি আর করবে রূপেশ্বরী! সেই ময়লা কাপড় পরা, হাতে-পায়ে


হাজাধরা রাখালের মা শুয়েছিল যেখানে সেখানে গিয়ে বসতে হলাে।


পনেরো দিন এইভাবে কেটেছে। রূপেশ্বরীর রূপ কোথায় মিলিয়ে গেছে। রােগা কালাে একটা কঙ্কাল চেহারা। কলসী নিয়ে পুকুরে জল আনতে গিয়ে হাপুস


নয়নে কাদছে। মাথার ওপর চড়া রােদ। ক্ষিদে তেষ্টায় প্রাণ যাচ্ছে।


একটা লাঠি হাতে নিয়ে ঠুকঠুকে এক বুড়ী এসে ঘাটের পাড়ে দাঁড়ালাে।


রূপেশ্বরীকে দেখে বলল, হ্যা বউ, আমায় একটু জল দাও না। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। রূপেশ্বরী চোখ মুছে বুড়ীকে জল এনে দিল। বুড়ী বললে, কাদছাে কেন গা? রূপেশ্বরী আরাে জোরে কেঁদে উঠে বললে, আমি আর পাচ্ছিনা। জলে ডুবে

মরবাে।


বুড়ী আস্তে আস্তে তাকে বুঝিয়ে সব কথা শুনলাে। আবার বললে শোনা




গাে বউ! কোনাে মানুষের অহঙ্কার থাকা ভালাে নয়। তুমি কত লােককে অপমান করেছ রূপের দেমাকে! মনে পড়ে কি? তারা তােমার দেওয়া অপমান ভুলতে পারে নি। তুমি কি এখন নিজের দোষ বুঝতে পেরেছ—অনুতপ্ত হয়েছ? হয়েছি, হয়েছি—আমি সব বুঝেছি, আমায় ক্ষমা কর।


আচ্ছা, মনে রেখাে কোনও মানুষকে অকারণ অপমান করার অধিকার তােমার নেই।


এই বলে বুড়ী লাঠিটা তুলে রূপেশ্বরীর মাথায় একটু আস্তে করে ঘা দিল। ওমা এ কী! এ কী কাণ্ড! কোথায় এলাম!! ঝলমলে রাজপ্রাসাদের একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছে রূপেশ্বরী। রাখালের মত মুখ এক রাজপুত্তুর তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে, বলছে অন্য কোথাও আস নি, নিজের শ্বশুরবাড়িতেই এসেছে। আমি চম্পানগরের রাজার ছেলে, যাকে স্বয়ংবরসভায় কালাে বিচ্ছিরী বলে অপমান করেছিলে। মনে আছে? পুরােনাে কথা থাক এখন, আমি রাখাল নই, সেজেছিলাম

তােমার জন্যই আমাদের এত অভিনয়ের আয়ােজন হয়েছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। চল আমার বাবা-মার কাছে। চম্পানগরের রাজা-রাণী এলেন এসো মা এসাে, ঘরের লক্ষ্মী ঘরে এসাে


বলে হীরার মুকুট পরিয়ে দিলেন। রাজা বললেন, সকলকে জানিয়ে দাও এক সপ্তাহ আমার রাজ্যে উৎসব চলবে। আর এখনি সুবর্ণের পানি আর সাত ঘােড়ার গাড়ী পাঠাও রূপেশ্বরীর বাবা মাকে আনতে। তাদের মেয়ের রাখালের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে কাঁদছে এখন এসে দেখে যাও কোথায় সে আছে। রূপেশ্বরী নত হয়ে শ্বশুর শাশুড়ীকে প্রণাম করলাে। তারপর উঠে উাড়িয়ে


চারিদিক দেখতে লাগলো রাজপ্রাসাদ, এত ঐশ্বর্য এ তাে বাপের বাড়ি চেয়ে অনেক বড়। অনেক বিশাল। স্বপ্ন দেখছে না তাে? তার মনের কথা বুঝতে পেরে রাজপুত্তুর বললে, কোনােটাই স্বপ্ন নয়। সব

সত্যি ।

No comments:

Post a Comment

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...