সাত ভাই দৈত
হরেন ঘটক
এক যে ছিল দেশে দেশে ছিল একটা লোক, নাম ছিল তার নসিরাম। এ সকালে সেই নাসিরামের মতাে এমন বীরপুরুষ নাকি আর কেউ ছিল না। লােক যতই তাকে বীরপুরুষ বলে জানুক, নাসিরাম কিন্তু নিজেকে খুব ভীরু পুরুষ বলেই জানত।
লােকে যা জানত তা সত্য মিথ্যে যাই হােক, নসিরাম যেটা জানত সেটা মিথ্যে ছিল না। তবে একথা সত্যি, নসিরাম ভীরু হলেও লােকটা ছিল বেজায় চতুর; তার কথাবার্তা শুনলে অতিবড়াে বিশ্ব - নিন্দুকও তাকে ভীরু বলে অপবাদ দিতে পারত না।
সে সব সময় এমন একটা ভঙ্গি দেখাত, যেন ভয় বলে কোনাে বস্তুই তার জানা নেই। নসিরাম মনে মনে অবিশ্যি অনেক কিছু দুঃসাহসের কাজ করবে বলে কল্পনা করত; কিন্তু তার কল্পনা শুধু কল্পনাতেই থেকে যেত।
বীর নসিরামের আপনজন বলতে কেউ ছিল না, তার সম্বলের মধ্যে ছিল, বাপ-দাদার আমলের এখানি সুতীক্ষ্ম তলােয়ার। সেই তলােয়ারখানিকে যে সে মাঝে মাঝে কাজে না লাগাত এমন নয় - যখনই সুযােগ পেত তখনই কোনাে নির্জন স্থানে গিয়ে সেটিকে নবন করে শূন্যে ঘােরাত আর কল্পনায় অনেক দৈত্য- দানবের মুণ্ডু কেটে ফেলত। অবিশ্যি, সত্যিকারের বিপদ যেখানে, সেখানে বীর নসিরামের টিকিটিও দেখা যেত না।
কিন্তু মজার ব্যাপার এই, লােকে বলত, থাকত আজ যদি নসিরাম, তবে দেখতে পেতে কী তার দুরন্ত সাহস। তার কাছে এ আবার একটা বিপদ নাকি? নসিরামের উপর এমনি ছিল তাদের অন্ধ বিশ্বাস। সে একদিনের একটা ঘটনা।
কোনাে একটা বনের পথে চলতে চলতে হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে নসিরাম চিৎকার করে উঠল, আজ দৈত্য বংশ সব নির্বংশ করব, তবে ছাড়ব। বলার সঙ্গে সঙ্গে তার কোষ-মুক্ত তলােয়ারখানি শূন্যে আস্ফালন করে উঠল,
বনবন -বন বন!
বন বন! বন বন!নসীরাম আজ মরিয়া। তাকে ঠেকাবার কেউ নেই। দৈত্যদের আজ ঘাের দুর্দিন। তলোয়ার বন বন শব্দে ঘুরেই চলছে। তলোয়ার ঘােরাতে ঘােরাতে নসিরাম দেখতে পেল, কেবল দৈত্য-দানবের মুণ্ডু কেটে ছিটকে এসে তার পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর রক্তে রক্তে - গঙ্গা বয়ে চলেছে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রণক্লান্ত নসিরামের তলােয়ার থামলে দেখা গেল, কোনাে দৈত্য-দানবের চিহ্ন নেই বটে, তবে তিন তিনটে মরা মাকড়সা পড়ে রয়েছে। বেচারি মাকড়সার জালের বাড়ি তৈরি করে সেখানে দিব্যি আরামেই বাস করছিল;তারা ভাবতেও পারেনি যে, বীর নসিরাম এমনিধারা ক্ষেপে গিয়ে দৈত্যদানবদের বদলে একদিন তাদেরই জীবন নাশ করে বসবে। নসিরাম খুঁজে খুঁজে দানব -মুণ্ডের পরিবর্তে যখন মৃত - মাকড়সা তিনটিকে দেখতে পেল তখন মনে মনে বলল, এ তিনটে মাকড়সা না হয়ে দৈত্যও ত হতে পারত।
দৈত্য যখন হতে পারত, তখন এদেরই বা দৈত্য বলে ধরে নিলে আপত্তির কারণ হবে কেন? সত্যিকারের দৈত্য হলেও তাে এমনি করেই কাটা পড়ত? কাজেই মাকড়সা আর সত্যিকারের দৈত্য মধ্যে কোন তফাৎ দেখছি না তখন এই তিনটেই দৈত্য! অতএব এক কোপে তিন দৈত্য বধের বীরত্ব নিয়ে বাড়ি ফিরবার অধিকার একমাত্র নসিরামেরই আছে।
তাই নসিরাম বাড়ি ফিরবার অধিকার একমাত্র নসিরামেরই আছে। তাই নসিরাম বাড়ি ফিরল। নসিরামের এই দৈত্যবধের খবর কিছুদিনের মধ্যেই দেশের চারদিক ছড়িয়ে
পড়ল। নসিরামের বাড়ির দরজায় লােকে লােকারণ্য। দেশের লােক তাকে অভিনন্দন জানাতে এল দলে দলে। দরজায় ঝােলান নসিরামের চকচকে তলােয়ারখানির গায়ে ঝকঝকে লেখা এই কথা কয়টি তারা অবাক বিস্ময়ে পড়ল - শ্রী নসিরাম শর্মা, লােকটা করিতকর্মা;
এক কোপে তিন দৈত্যি
কাটার খবর সত্যি। এসব শুনে নসিরামের ওপর দেশের লােকের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। ক্রমে তার বীরত্বের কথা দেশ থেকে দেশান্তর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এহেন বীর নসিরাম একদিন ঠিক করল বিদেশ ভ্রমণে বেরুবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। শুধুমাত্র একটা ময়দার থলি পিঠে ঝুলিয়ে তলােয়ারটি হাতে নিয়ে যে বেরিয়ে পড়ল নিরুদ্দেশের পথে।
নসিরাম চলেছে নিরুদ্দেশের পথে। চলেছে তাে চলেছেই - কোনাে দিকে তার ভুক্ষেপ নেই। সারাদিন পথ চলার শ্রমে ক্লান্ত হয়ে নসিরাম অবশেষে একটা
বটের ছায়ায় বসে পড়ল একটু বিশ্রাম নেবে বলে। ময়দার থলিটা লুকিয়ে রেখে, তলােয়ারটা হাতে নিয়ে এক সময় সে নাকের ডাক সরু করে দিল। সন্ধ্যা তফন হয়
হয়। সাত ভাই দৈত্য চলেছে সেই পথেই। হঠাৎ ঘুমন্ত নসিরামের ওপর চোখ পড়তেই তারা থমকে দাঁড়াল। চকচকে তলোয়ারের উপর ঝকঝকে লেখাগুলাে
তারা চট করে পড়ল -
শ্রীরাম শর্মা, লােকটা করিতকর্মা;
এক কোপে তিন দৈত্য
কাটার খবর সত্যি।
সাত ভাই দৈত্যদের মধ্যে এক ভাই বলল, “চল ভাই, আমরা এখান থেকে সরে পড়ে কিন্তু যে- সে শত্রু নয়।”
আর এক ভাই বলল, "দাঁড়াও না, আমরা তাে সাত ভাই রয়েছি, ভয়টা কীসের? চল, লােকটার সঙ্গে একটু আলাপ করেই দেখি না কেন?” ঘুমন্ত নসিরাম স্বপ্ন দেখছিল, একদল চোর তার ময়দার থলিটা চুরি করে
নিয়ে যাবার জন্যে চুপি চুপি এগিয়ে আসছে, ঘুমের ঘােরেই সে তার তলােয়ারটা বাগিয়ে চিৎকার করে লাফিয়ে বলে উঠল, খবরদার জোচ্চোরের দল। সাত ভাই এগিয়ে আসছিল, তারা নসিরামের কান্ড দেখে থমকে দাঁড়াল।
সাত ভাই দৈত্য যে একটু না ভড়কিয়ে ছিল এমন নয়। তাদের মধ্যে একভাই সাহস করে নসিরামকে বলল, বন্ধু, তুমি যে একজন প্রকান্ড বীর তা তাে তােমার তলােয়ারখানা দেখেই বুঝতে পারছি। আচ্ছা বন্ধু, তােমার বীরত্ব বিশেষত্ব কিছু আছে, দেখাতে পারাে? নসিরাম ময়দার থলি চুরির স্বপ্ন দেখেই লাফিয়ে উঠেছিল, তার সামনেই যে এমন বিপদ রয়েছে তা সে কল্পনাও করেনি। চোরের বদলে এই বিরাট চেহারার সাত ভাই দৈত্যদের দেখে সে ভয়ে-ভাবনায় একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু দৈত্যরা বন্ধুর মতাে:আলাপ করছে দেখে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার বীরত্বের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, আমি মাটিতে লাথি মারলেই ধুলাে উড়ে সব অন্ধকার হয়ে যাবে, এই দেখে তার প্রমাণ বলেই সাত ভাই দৈত্যদের অলক্ষ্যে ময়দার থলির মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিয়ে ময়দাগুলােকে সে ছড়িয়ে দিতে লাগল। আর দেখতে দেখতে সব অন্ধকার হয়ে গেল।
ময়দার ধুলাের সেখানটা এমন হল যে, পরস্পরকে কেউ তারা দেখতে না পেয়ে বলল, অদ্ভুত বটে! নসিরামের বীত্বে মুগ্ধ হয়ে সাত ভাই দৈত্যরা তাকে সসম্মানে তাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের আদরের ছােটো বােনকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিল। বীর নসিরামের আনন্দ আর ধরে না- দিন তার আনন্দেই কাটতে থাকল। একটানা আনন্দের মাঝখানে হঠাৎ একদিন নসিরামের মনে নিরানন্দ এসে
হানা নিল। কিছুদিন থেকে সাত ভাই দৈত্যদের রাজত্বে একটা গণ্ডারের উপদ্রব শুরু হয়েছে সাত ভাই তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে নসিরামকে এসে বল, চলাে বন্ধু, গন্ডার মেরে আসি। নসিরাম এতবড়াে বিপদে জীবনে কখনও আর পড়েনি।
গন্ডারের নাম শুনে ভয়ে তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হলেও সাতভাই দৈত্যদের অনুরােধ উপেক্ষা করার উপায় ছিল না তাই কৌশলে এই বিপদ এড়াবার জন্যে সে বলল তােমরা এগিয়ে চলাে,
আমি আমার তলােয়ারটা শানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সাতভাই দৈত্যদের একভাই বলল, বন্ধু, গন্ডার ভীষণ জন্তু, এর সামনে একা পড়লে রক্ষা থাকবে না চলাে, এক সঙ্গেই যাই। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি দেখিয়ে নসিরাম বলল, হ্যা, গন্ডার আবার একটা জন্তু, সেটাকে আবার ভয়। তােমরাও যেমন ক্ষেপেছ। তােমরা যাও, আমার জন্যে তােমাদের ভাবতে হবে না। নসিরামের এ-হেন দুর্জয়
সাহস দেখে ভগ্নিপতির ওপর সাতভাই দৈত্যর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল অপরিসীম। নসিরামকে একা রেখেই সাতভাই বেরিয়ে গেল গন্ডারের খোঁজে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলনসিরাম। এবার মনে মনে ঠিক করে ফেলল সে কোনাে একটি গাছের ওপর উঠে নিশ্চিন্তে আত্মগােপন করে থাকবে, বিপদ কেটে গেলে তবে নিচে নামবে সে।
তার আগে নয়। বড়াে একটি গাছ দেখে তার ওপর উঠে আত্মগােপন করে বসে রইল নসিরাম। সাতভাই দৈত্যরা আজ মরিয়া। তারা গন্ডারটিকে আজ মারবেই। তাদের তাড়া খেয়ে গন্ডারটিকে এই গাছের তলায় আশ্রয় নিতে দেখে ভয়ে আতকে উঠল সে। তারপর আতঙ্কে কাপতে কাপতে পড়বি তাে পড় - এক্কেবারে সেই গন্ডারটির পিঠের উপর। শব্দ হল ধপাস।
শত্রুর তাড়া খেয়ে গন্ডারটির মনে এমনিতেই ভয় ঢুকেছিল। হঠাৎ সিরামের দেহটি তার পিঠের ওপর টিপ করে পড়তেই আঁতকে উঠে চৌাঁচা দৌড় ছুটতে লাগল ওটা। গন্ডার তাে ছুটছে আর ছুটছে। - থামবার আর নাম নেই। নসিরামের সংজ্ঞা ফিরে এল নসিরামের। সে তখন টের পেল গন্ডার তাকে পিঠে নিয়ে ছুটছে।
এবার সে টান টান হয়ে। বড়াে রকমের শত্রুর পাল্লায় পড়েছে ভেবে গল্ডারটিও দায়ে ছুটতে লাগলাে আরও জোরে।
এদিকে সাত ভাই দৈত্যেরা তাে গন্ডারটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ শত্রুটি তাদের পানেই ছুটে আসছে দেখে গন্ডারের দুটি চোখ লক্ষ করে তারা তীক্ষ্ তীর ছুড়ে মারল। বিষাক্ত তীরের তীব্র আঘাতে গন্ডারটি মুহূর্তে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল।
সাতভাই দৈত্য মৃত গন্ডারটির কাছে ছুটে আসতেই নসিরাম রেগে মেগে চিৎকার করে বলে উঠল - তোমরা সাত ভাই ভীরু কাপুরুষ! এতকষ্ট করে গন্ডারটিকে ধরলাম পােষ মানাব বলে আর তােমরা কিনা সেটিকে খুন করলে? ছ্যা! ছ্যা!
দেখে - শুনে সাত ভাই দৈত্য তাে এক্কেবারে হতভম্ব! তাদের ত্রুটি স্বীকার করে ভগ্নিপতি নসিরামকে সম্ভ্রম দেখিয়ে বলল - বন্ধু, তােমার বীরত্বের তুলনা নেই। তােমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আজ আমরা ধন্য। ধন্য আমাদের দৈত্যকুল।
No comments:
Post a Comment