Friday, September 11, 2020

নীল পরীর দেশ

 নীল পরীর দেশ


প্রভাবতী দেবী সরস্বতী



রাজার ফুল বাগান-গাছ আলাে করে থাকে রঙবেরঙের ফুলে, বাগানের চারিধারে তারের বেড়ার আড়ালে অনেকদূর থেকে দেখা যায় ফুলের রং,
ফুলের রূপ। নানা গাছের সবুজ পাতার আড়ালে ফুলেরা থাকে কুঁড়ির ঢাকনির আড়ালে, সবুজ ঘােমটা তুলে একটু করে উকি দেয়; বাতাস এসে তাদেরই যায় দুলিয়ে, অনুনয়
বিনয় করে"ঘোমটা খােল ফুলরাণি সবুজ ঘােমটা খােল।

যেমন তাদের রূপ, তেমনি তাদের গন্ধ। সেই রূপ ও গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কত
দূর হতে ছুটে আসে কত নাম না জানা পাখী; তারা গান গায় হাজার রকম সুরে; ছুটে
আসে প্রজাপতি ফুলে ফুলে বেড়িয়ে বেড়ায়। দুনিয়ার যত ভালাে আর আশ্চর্য্য ফুল আছে, রাজা সব গাছ এনে লাগিয়েছেন তার বাগানে। বাগানে ফুল ফুটানাের সখ তার যােল আনা, দেশ-দেশান্তর হতে লােক আসে রাজার ফুল বাগান দেখতে। রাজা রাজকার্য করেন, প্রাণমন পড়ে থাকে ফুল বাগানের দিকে।


কোন ফুলটা সবুজের আড়াল হতে কেবলমাত্র উঁকি দিচ্ছে, কোন ফুলটা সহস্রদল মেলেছে, কোন ফুলের পাপড়ি খসতে সুরু হয়েছে সব, যে কোন দিন তিনি বলে দিতে পারেন। রাজা দোতলায় খােলা জানালার কাছে শুয়ে ফুলের বাগান দেখেন, ফুলের গন্ধে বিভাের হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
নীল পরীর দেশ


এক ঝাক পাখি রাজার ফুল বাগানে এসে ভারী উপদ্রব সুরু করেছে। মালিরা তাদের দৌরাত্ম্যে অস্থির। এত ছােট পাখি, লম্বায় এক আঙ্গুলের বড় নয়। লাল টুকটুকে তাদের দু'খানা পাখা, ঠোট আর চোখ, গা-টি নরম ও সবুজ। তাদের ফুল চুরির প্রধান সহায় হল তাদের গায়ের রঙ। মালিরা ঠিক করতে

পারে নাকোনটা ফুল কোনটা পাখী, কোনটা পাতা; রঙে রঙে মিলে সব হয়ে যায় একাকার। মালিরা তীর-ধনুক ঠিক করে ভয়ে তীর ছুঁড়তে পারে নাপাছে ফুলের পাপড়ি ছিড়ে গিয়ে খসে পড়ে।
পাখির দল প্রজাপতির মত ফুলে ফলে বসে, ছােট ছােট লাল টুকটুকে ঠোট দিয়ে পাপড়িগুলাে উল্টোয় পাল্টায়, ছিড়ে কুচি কুচি করে মাটিতে ফেলে দেয়। এতে তারা কি আমােদ পায় তারাই জানে।

রাজা জানলা হতে ফোটা ফুল দেখতে পান না
এ কি ব্যাপার,এর মানে?
প্রধান মাটির তলবে পড়ে
প্রধান মালি ভয়ে ভয়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। রাজা বজ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ফুল আর গাছে ফোটে না কেন, গাছের
আর যত্ন করা হয় না বুঝি? প্রধান মালি কাপতে কাপতে বলতে লাগল, “মহারাজ, কতকগুলাে
পাখি
রাজা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, পাখী-কতগুলো পাখী, তুমি কি বলতে চাও

পাখীরা ফুল ফুটতে দেয় না?" হাত জোড় করে প্রধান মালি বললে, “হুজুর তাই, আপনি নিজে যদি একদিন
স্বচক্ষে দেখেছেন।”
রাজা বললেন, “আজই যাব।”
রাজকার্য্যের ভার রইল মন্ত্রীর ওপর, রাজা গেলেন বাগানে। এইবারই বাধলাে মজা।
রাজার মাথার মুকুট ঝিলমিল করছে, পােষাক ঝিল্মিল করছে, তাই দেখে ছােট পাখীগুলাে দলশুদ্ধ পড়লাে রাজার উপর ঝাপিয়ে। কেউ ঠুকরায় মুকূটে, কেউ পােষাক, কেউ তলােয়ার। রাজার অবস্থা তখন যা হলো আর বলবার নয়। রাজা দুই হাত শূন্যে তুলে লাফান, পাখিদের মারতে যান কিন্তু তার কিল, ঘুসি একটা পাখির গায়েও লাগে না। তার চীৎকারে একশাে মালি ছুটে আসে, সিপাই-শাস্ত্রী ছুটে
আসে। 

কিন্তু এলেই বা কি? তারা সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকে একটা পাখিকে মারতে পারে না পাছে রাজার গায়ে লাগে।

রাজা চেঁচান রক্ষা কর-রক্ষা-কর-রক্ষা কর।
কিন্তু কে তাকে রক্ষা করতে গিয়ে মেরে ফেলবে? অবশেষে হতভম্ব প্রধান মালি দৌড়াল মন্ত্রীর কাছে যদি তিনি কোন মন্ত্রণা
দেন। 
মন্ত্রী ছুটে এলেন। লক্ষ্য করে বুঝলেনপাখীদের লােভ আসলে রাজার উপর নয়, ঝিলমিল জিনিসগুলাের উপর। বুদ্ধি করে তখনই তিনি রাজার মুকুট,
পােষাক আর তলােয়ার নিয়ে ফেলে দিলেন। 
রাজা ইাফ ছেড়ে বাঁচলেন, কপালের ঘাম মুছে সরে দাঁড়ালেন। মন্ত্রী বিবেচনা করে বললেন, “এ পাখীদের মারা যাবে না, খুব জোরে কোন
আওয়াজ কর, তাতে পাখীরা ভয় পেয়ে যদি পালায়।”
মন্ত্রীর বুদ্ধি পাখির ঝাককে তাড়ান গেল। 
কিন্তু একটা পাখি পালাতে গিয়ে বেড়ায় গেল আটকে রাজা নিজের হাতেই তলােয়'র দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে
মেরে ফেললেন। সেই দিন গভীর রাত্রে একটা বিকট শব্দে রাজার ঘুম ভেঙ্গে গেল; মনে হলবাগানের উপর দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বয়ে গেল। সকাল বেলা প্রধান মালির চিৎকার"মহারাজ, মহারাজ, সর্বনাশ হয়েছে।”


ধড়ফড় করে উঠে রাজা জিজ্ঞাসা করেন, "কি?"
মালি কেঁদে ফেলে বললেন, “ফুলগাছ শুয়ে পড়েছে হুজুর, পাতা সব নুইয়ে
পড়েছে।” রাজা দুইচোখ কপালে তুলে বাগানে ছুটে যান।
একটিমাত্র ফুলগাছে একটিমাত্র ফুল ফুটে রয়েছে ঠিক বেড়ার ধারে আর মাইলের পর মাইলব্যাপী গাছ মাটিতে শুয়ে; মনে হচ্ছে, কাল রাত্রে ভীষণ ঝড়ের উপর দিয়ে।
দমকা হওয়া বয়ে গেছে এদের
কত লক্ষ লক্ষ টাকা আর কত যত্ন, ভালােবাসা
রাজা যেন পাগল হয়ে উঠলেন। 

এরকম কেন হল; কোন দেবতার শাপে
তার এত বড় বাগানের এ অবস্থা হল?
মন্ত্রী এলেন, সভাসদবৃন্দ সবাই এলো—শহর হতে আনা হল বড় বড়
জ্যোতিষী, তারা কেউ গুণে যদি ঠিক করে বলতে পারেতার গাছগুলােকে আবার তাজা করার উপায় বলে দেয়, তাদের উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে। 

প্রধান জ্যোতিষী খড়ি দিয়ে অনেক আঁক কষে গম্ভীর মুখে বললেন, সর্বনাশ
হয়েছে মহারাজ, আপনার বাগান পরীর দৃষ্টিতে পড়েছে। পাখী হয়ে যারা উপদ্রব করতাে তারা সব পরী। একদিন এখান দিয়ে চলে যেতে ফুলের রূপে আকৃষ্ট হয়ে তারা পাখীর রূপ নিয়ে এখানে আটকে পড়েছিল। আপনি তাদের মেরে ফেলেছেন, পরীর দীর্ঘশ্বাসে তাই আপনার ফুলবাগান শুকিয়ে উঠেছে।”
পরী?
রাজা মাথায় হাত দিয়ে বসেন,এখন উপায়? কি করলে পরীর দৃষ্টি এড়ানাে যাবে?”
জ্যোতিষী বললেন, “ওই যে একটিমাত্র গাছে একটিমাত্র ফুল ফুটে আছে, ওইটি নিয়ে যেতে হবে সেই সাত সমুদ্রের ওপারে নীলদ্বীপে, সেইখানে থাকে নীলপরীদের রাণী। তাকে যদি কোন রকমে খুশী করতে পারেন, আপনার বাগান আবার তাজা হয়ে উঠবে।

রাজা জ্যোতিষীকে বকশিস দিয়ে বিদায় করে তখনই সমুদ্রের ওপারে নীলদ্বীপে যাওয়ার উদ্যোগ করেন।
রাণী আছড়ে পড়ে কাঁদেন"যেয়ো না," ছেলে হাত ধরে কাদে যেয়াে ।” কিন্তু রাজার ফুলবাগান একদিকে, আর সব একদিকে। রাজার ময়ূরপঙ্খী নৌকা তৈরী হল, রাজা তেত্রিশ কোটি দেবতাকে প্রণাম

করে সেই একটি গাছের একটি ফুল তুলে নিয়ে ময়ূরপঙ্খী উঠলেন। ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়ে ঝড়ের মত একটা দমকা বাতাস বয়ে
গেল। তীক্ষ্মসুরে কে যেন বলে গেল-"সাবধান-সাবধান-সাবধান। রাজা চমকে ওঠেন, মন্ত্রী চারিদিকে চান, কে একথা বললে? সবাই তাকায়
পরস্পরের দিকে কেউ তাে একথা বলে নি। 

রাজার ময়ূরপঙ্খী অথই জলে সাগর বুকে ভাসলাে। রাণী সাতমহল বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেন, নৌকা ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে, রাজপুত্র মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, ময়ূরপঙ্খীর রঙিন হাল নীল আকাশের বুকে মিলিয়ে গেল। মা ছেলে দুজনে আছড়ে-পিছড়ে করে কাঁদেন।
দিনের পর দিন যায়, বৎসরের পর বৎসর যায় রাজা আর রাজ্যে ফিরলেন । রাজ্যময় বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলােচুরি, ডাকাতি লুঠ চললাে। রাজার বড় সাধের ফুলবাগানের বেড়া ভাঙতে শুরু করলে, কিন্তু আশ্চর্য বৎসরের পর বৎসর ধরে গাছগুলাে একইভাবে পড়ে রইল—একটি পাতাও তাদের শুকলাে না। 

বাগানের এক কোণে একটি গাছে একটি করে ফুল প্রত্যহ ফুটতে লাগলাে, কোন দিনই ফোটা বন্ধ হলাে না।
রাজপুত্র অরুণকুমার মায়ের কাছে অনুমতি চায়,“তুমি আদেশ দাও মা, আমি বাবাকে আনতে যাই। পরীরা হয়তাে বাবাকে বন্দী করে রেখেছে, চাকরের মত খাটাচ্ছে, আমি বাবাকে নিয়ে আসি।
রাণী কাদতে কাঁদতে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নেন, তুই কি পারবি অরুণ, তুই যে বড় ছেলেমানুষ।
অরুণ হাসে,বলে, "আমি মস্ত বড় হয়েছি বুও তুমি আমায় ছেলেমানুষ বল। তেরাে বছর বয়স আমি তুমি আমায় ছেলেমানুষ বলে না। এক বছর তুমি অপেক্ষা করাে এক বছরের মধ্যে আমি বাবাকে নিয়ে ময়ূরপন্থী নৌকা নিয়ে ফিরে আসবাে দেখে।”
রাণী আর কি করেন।
ছেলের জিদে তাকে বিদায় দিতেই হল। রাজপুত্র বাগানের একটি মাত্র ফুল তুলে নিলে। জ্যোতিষীর কাছে সে শুনেছিল একটি মাত্র গাছ যে পরীর দৃষ্টি এড়াতে পারে। এই একটি মাত্র ফুল যার কাছে যতক্ষণ থাকবে, পরী ততক্ষণ তার কোন অনিষ্ট করতে পারবেনা। এই ফুল হারানাের


সঙ্গে সঙ্গে সে আগেকার সব কথা ভুলে যাবে এবং পরীর মায়ায় পড়তে হবে। রাজপুত্র অরুণকুমার একটা ছােট্ট নৌকায় উঠলাে, চারজন মাত্র দাড়ি মাঝি তাতে।
রাণী কাদতে কাদতে আশী্বাদ করে ছেলেকে বিদায় দিলেন। রাজপুত্র অরুণকুমারের নৌকা ভেসে চললাে সাতসাগরের ওপারে নীলদ্বীপের
উদ্দেশ্যে, যেখানে নীলপরীর কাছে তার বাপ বন্দী হয়ে রয়েছে। নৌকার ঠিক সামনে আকাশের কোল বেয়ে চলছিল একটা পাখি সেই পাখীটাই যে অরুণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছিল। 

বুড়াে মাঝি বলছিল, এরকম পাখী মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়, এরা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। দিনের পর দিন যায়, জলের আর শেষ নাই, কোথায় সাতসাগরের পারে সেই নীল দ্বীপ চিহ্ন ও দেখা
যায় না।
জ্যোতিষীর কথার পরে অরুণের অগাধ বিশ্বাস। বুড়াে মাঝি মাঝে মাঝে আবল তাবল বকে, বলে, জ্যোতিষী মিছে কথা বলছে। কিন্তু কুমার তা বিশ্বাস
করে না।
ফুলটাকে সে সব সময় নিজের কাছে রাখে।
আশ্চৰ্য্য—দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যায়, ফুলটা যেমন তাজা তেমন
তাজা রয়েছে, একটা পাপড়ি শুকায় নি, রং পর্য্যন্ত খারাপ হয়নি। অনেকদিন পরে দাড়ি-মাঝিরা চীৎকার করে উঠলাে, "একটা দ্বীপ দেখা
যাচ্ছে।
ই-ই তাহলে নীল দ্বীপ।
কুমারের আর আনন্দ দেখে কে?
রাত্রে আকাশ ছেয়ে গেল ঘন কালাে মেঘে, সো সৈে করে ঝড় এলাে। অরুণ বুঝতে পেরেছে এসব পরীর মায়া, সে ফুলটিকে জামার পকেটে রেখে সূতা দিয়ে পকেটটাকে এমন করে সেলাই করলে যাতে কিছুতেই সে ফুল পড়ে যাবে
না।
সে সাৈ করে একটা ভীষণ দমকা ঝড় এসে ছােট্ট নৌকাখানাকে শুদ্ধ দ্বীপের
উপর আছড়ে ফেললে।
পড়বার সেই ভীষণ আঘাতে অরুণ মূচ্ছিত হয়ে পড়ল; মাঝি-মাল্লারা নৌকা হাতে কে কোনদিকে ছিটকে পড়ল, কেই বা তার হিসাব রাখে, কেই বা তা দেখে?


পূবের লাল আলাে ধরার গায়ে পরশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরুণের মূচ্ছার ভাব কেটে গেল, সে ধরফড় করে উঠে বসলাে। তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দেখল—না, ফুলটা ঠিক আছে। তবে সে
পরীর মায়ায় কিছুতেই পড়বে না, তাই পিতাকে সে নিশ্চয়ই মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারবে।
মাথার উপর দিয়ে কে যেন বিদ্রুপের হাসি হেসে গেল—হা-হা-হা অরুণের গা কাঁটা দিয়ে উঠলাে, সে মুখ তুলে চাইলে, কোথাও কিছু দেখতে
লে না।
অরুণ সামনের দিকে এগিয়ে চললাে।
কি সুন্দর পথ, যেন মােমে তৈরী দু ধারে কত ফুল গাছ, কত ফুল ফুটেছে।
এক জায়গায় তার বয়সী অনেকগুলাে ছেলে মেয়ে খেলছে। অরুণকে দেখে তারা কাছে দৌড়ে এলাে, কে ভাই তুমি, কোন দেশের রাজপুত্র ? এসাে না আমাদের সঙ্গে কানামাছি খেলবে?
কাণামাছি হওয়ার ফাকে ফুলটি যাবে।
অরুণ মাথা নাড়লে, গম্ভীরভাবে এগিয়ে চললাে। খানিক দূরে যেতেই পেছনে হাে হাে হা হা হাসির শব্দ। পেছনে ফিরে দেখে সব মিলিয়ে গেছে। পথে দেখা গেল, কত হিংস্র জন্তু তারা হাঁ করে খেতে চায়, কিন্তু কাছে
আসতে পারে না। 

চট করে সামনে একখানি লম্বা মাটি চিরে বার হতে পড়লাে স্রোতবতী এক নদী। অরুণ ভয় না পেয়ে নদীর জলে দিল পাতখনি সে নদী গেল শুকিয়ে। সামনে জেগে উঠল মস্ত বড় পাহাড়, তখনি গেল মিলিয়ে। 

যেতে যেতে সামনে জাগলাে মস্ত বড় বড় গ্ভপা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গৰ্ত্ত মিশে গেল। এ সবের জন্য অরুণ প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। তার কাছে যতক্ষণ ফুল থাকবে
ততক্ষণ কেউই তার এতটুকু অনিষ্ট করতে পারবে না, তার মাথার চুল নড়াতে পারবে না তা' সে জানে। সে পকেটের উপর হাতখানা রেখে সােজা হন হন করে
চললে। 

কোথায় বাজে বাঁশিকি মিষ্ট সে বাঁশির সুর-মুহূর্তের জন্য অরুণ যেন অভিভূত হয়ে পড়লাে, এমন বাঁশীর সুর সে খুব কম শুনেছে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লাে, মা বলেছেন, পরীরা মায়া জানে, তারা মায়া করে মানুষকে ভেড়া গরু পাখী যা খুশী করতে পারে।


অরুণ দেখতে পেলে একটি ফুলের বাগানে লক্ষ লক্ষ ফুল ফুটেছে, সেখানে কোমল দূৰ্বার উপর কত সুন্দরী মেয়ে কে গান গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ বাঁশী বাজাচ্ছে। মাঝখানে রত্নাসনে বসে আছে পরমা সুন্দরী একটা মেয়ে। 

অরুণকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।-এসে কুমার, আমরা তােমার জন্যে
বসে আছি। এই নাও—সিংহাসন নাও, মুকুট নাও, মালা নাও; সব নাও তুমি এখানকার রাজা হয়ে বাস কর।” অরুণ একবার পকেটে হাত খানা রাখলে তারপর থু থু করে কতকটা থুথু
তাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। 
দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মিলিয়ে, কোথায় গেল সেই সব পরীরা, কোথায়
গেল ফুলবাগান, পরীর গান সেখানে জেগে উঠলাে ধূ ধূ মরুভূমি, গাছ নাই ঘাস নাই, লতা নেই-পাতা নাই।
অরুণ দেখতে পেলে দূর হতে একটি লোক আছে সে যেন হাঁটতে পারছে না, পা তার ভেঙ্গে পড়েছে। তার মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে, একমুখ সাদা
দাড়ি-গোঁফ, হাতে পায়ে বড় বড় নখ।
অরুণ প্রথমটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপরই চোখের দিকে চেয়ে
সে চিনতে পারলে, এই তার বাবা "বাবা-বাবা"
অরুণ দুই হাত তুলে তার বাবার কোলে ছুটে গেল।
রাজা প্রথমে চিনতে পারেন নি, তারপরই চিনতে পেরে ছেলেকে বুকের
মধ্যে চেপে ধরে ঝর ঝর করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। 

মাঝি-মাল্লাদের খুঁজে অরুণ নৌকো ঠিক করে পিতাকে নিয়ে নৌকায় উঠলাে।
পরীর মায়ার আকাশ তখন কালাে মেঘ ছেয়ে এসেছে। নীল দ্বীপে তখন ভূমিকম্প, অগ্নিবর্বণ শুরু হয়েছে। 
চারিদিকে হুম-হাম, দুমদাম শব্দ, কান্না-হাসি, তর্জন-গর্জন—
সে সব শব্দে কানপাতা দুরাহ। রাজা বললেন, "কিছু করতে হবে না, একশােবার দেবতার নাম করে নৌকো ছাড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে!”
একশােবার দেবতার নাম করে নৌকো ছাড়া হল। আকাশ হয়ে গেল পরিষ্কার শব্দ সব মিলিয়ে গেল। নৌকা সাগরের বুক চিরে সো সো করে ভেসে চলে।


রাজার সব কথা শোনা গেল।
রাজা আসতে গিয়ে ঝড়ের বেগে নীলদ্বীপে আছড়ে পড়েন, ফুলটা সেই
সময় হারিয়ে যায়। পরীরা তাকে সিংহাসন, মুকুট দেওয়ার লােভ দেখায় রাজা সহজেই ভুলে যান।
তারপর হল দুর্গতির একশেষ।
রাজা ক্রমে ক্রমে সব কথা ভুলে গেলেন; তাদের চাকর হয়ে সেখানে বাস
করতে লাগলেন। এক একদিন মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হতে, কিন্তু দেশে ফিরবার
কোনাে উপায় পেতেন না।
দেশে ফিরেই কুমার আগে নাপিত ডেকে পিতার চুল, নখ সব পরিষ্কার করে
নিয়ে তার পােষাক-পরিচ্ছদ পরিয়ে বাড়ী নিয়ে গেল। রাণীর চোখের জল আর বাধা মানে না—উপছে উপছে পড়ে। রাজ্যময়
সেরগেল, রাজা ফিরে এসেছেন রাজ্যময় উৎসব শুরু হল। রাজার বাগানে আবার ফুল ফুটলাে, রাজা জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেনশােয়া
গাছগুলি সটান হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার নূতন নূতন পাতা জন্মালাে, কুঁড়ি ধরলাে,
ফুল ফুটলাে। আকাশের বুকে হতে আবার বয়ে আসে দক্ষিণ হাওয়া; ভ্রমর-প্রজাপতিরা আবার ছুটে এলাে।
রাজা শুধু তাকিয়ে থাকেন, চোখের পলক তার পড়ে না।

No comments:

Post a Comment

সুন্দরবনে শিকার অভিযান

 সুন্দরবনে শিকার অভিযান নীরাজনা ঘোষ অজয় বিজয় দুই বন্ধু। দুজনে এখন একই কলেছে পড়ে। বি.এস.সি। একই সময় কলেজে আসে, পাশাপাশি বসে। পড়াশোনা ভাল...