অরণ্যের অধিপতি
রাধারাণী দেবী
ভীর অরণ্যের ঠিক মাঝ-মধ্যিখানে হাজার বছরের পুরােনাে বিরাট গ বিটবৃক্ষ লক্ষকুরি। একা লক্ষঝুরিই একটা অরণ্য যেন। তার ডালে-ডালে শাখায় শাখায় হাজার-হাজার পাখ-পাখালির বাসা—কোটি-কোটি কীট-পতঙ্গের গর্ভ। তা ছাড়া মােটা-মােটা ঝুরির অরণ্যে ঝুপসি আঁধারে বাস করে কত জন্তু জানােয়ার! বাঘ-ভাল্লুক-নেকড়ে-বরা থেকে—খরগোশ বেঁজী বনবিড়াল পর্যন্ত। লক্ষঝুরিকে মেনে চলে সারা অরণ্য! সমস্ত বৃক্ষ তরুলতা গুল্ম জীব-জন্তু পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ—সকলেই। লক্ষঝুরি ক্রুদ্ধ হলে আর রক্ষে নেই! একবার
রেগে মাথা ঝাকুনি দিলে সারা অরণ্যে প্রলয় উপস্থিত হয়ে যায়। লক্ষঝুরির মাথা থেকে নেমে আসা ঝুরিগুলিই এখন এক-একটা বিপুল বনস্পতির মত। তাদেরও কোটরে-কোটরে অজগর সর্প-কালফণী-পাতায় পাতায় নানা পক্ষী-অঙ্গে-অঙ্গে শতশত কাঠবিড়ালীর ওঠা-নামা ছুটোছুটির বিরাম নেই সমস্ত দিন।
এই লক্ষঝুরির সবার চেয়ে উঁচু শীর্যে শিখরে—আগডালের মগ আগায় সােনালী খড়ে রূপােলী ঘাসে সুন্দর বিনুনী করা বাসা বেঁধে বাস করতাে এক ব্যাঙ্গামা আর ব্যাঙ্গমী।
ঘন অন্ধকারের কালাে চাদর মুড়ি দেওয়া এক গভীর নিশুতি রাত্রি।
চারিদিকস্তব্ধতার ভারী পাথর চাপা পড়ে নিথর নিস্পন্দ। চাঁদহীন শােকাচ্ছন্ন
আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র শুধু ঝিম-ঝিম করছে। জ্যোৎস্না হারা গভীর অরণ্যে রাশি রাশি অন্ধকার গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়ে জমেছে। লক্ষঝুরির বিরাট প্রাসাদের মহলে মহলে একতলায় দোতলায় তলায় চার তলায়—কে বলি ফিফা শব্দে বাতাসের চুপি চুপি মন্ত্রণা পরমর্শ চলছে সারা রাত ভরে।
ব্যাঙ্গমা বলে ব্যাঙ্গমী! জেগে না ঘুমিয়ে ? ব্যাঙ্গমী জবাব দেয় আধ-ঘুমে আধ-জায়গায়।তুমি?
ব্যাঙ্গমা বলে আমিও তাই। তার চেয়ে আয় গল্প করি।
ব্যাঙ্গমী বলে বেশ তাে। ব্যাঙ্গমা বলে ব্যাঙ্গমী! সেই যে বিজন দেশের রাজপুত্র ডানহাতে সোনার তরােয়াল, বামহাতে হীরেমুখী বা নীল রংয়ের পঙ্খিরাজ ঘােড়ায় চড়ে
তার হারানাে ছােটবােনটিকে খুঁজতে বেরিয়েছিল—মনে আছে তাের? ব্যাঙ্গমী বলে মনে আবার নেই? এমনি আজকের মতনই এক নিবিড়
অমাবস্যার নিঝঝুম রাতে রাজপুত্র এসে নীল ঘােড়া বেঁধেছিলেন না আমাদেরই এই লক্ষঝুরি মহাবটের প্রাসাদ তলায়? সেই রাত্রে রাজপুত্তুর আমাদেরই এই বৃক্ষ
প্রাসাদের দোতলার মহলে শুয়ে রাত কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাঙ্গমা বলে ঠিক। কিন্তু জানিস্ কি সে-বেচারা আজও দেশ-দেশান্তরে
অরণ্যে-প্রান্তরে সাগরে পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছে হারানাে বোনের খোঁজে?
ব্যাঙ্গমী গম্ভীর স্বরে বলে জানি।
ব্যাঙ্গমা বলে -আরও কিছু জানিস কি?
ব্যাঙ্গমী জবাব দেয়নি বৈকি।
ব্যাঙ্গমা রাগ করে বলে জানিস তাে বল দেখি।
ব্যাঙ্গমী বলে জানি তার সে হারানাে ছােটবােন কোথায় আছে।
ব্যাঙ্গমা বলে আমি তাের চেয়ে বেশি জানি।
ব্যাঙ্গমী বলে শুনি।
ব্যাঙ্গমা চুপিচুপি বলে আমি জানি কোন্ উপায়ে রাজপুত্তুর হারানাে
রাজকন্যাকে খুঁজে পেতে পারেন। ব্যাঙ্গমী বলে—বলে না—শুনে।
ব্যাঙ্গমা বলে দেশ-দেশান্তর, শহর-গ্রাম, বন-মরুভূমি, সমুদ্র-পর্বত ছুটে ছুটে কিছুই হবেনা। এই মহা-অরণ্যের অধিপতি আমাদের লক্ষঝুরির তলায় তিনদিন তিনরাত্রি খাড়া দাঁড়িয়ে উর্ধ্ব-আকাশে চক্ষু মেলে তপস্যা করে লক্ষঝুরিকে প্রসন্ন করতে পারলে, লক্ষ ঝুলি তাঁর বিরাট কোটরের অধিবাসী সাতশাে বছরের কালনাগ
হুকুম দেবেন তার মাথার মণি মাটিতে ফেলতে। সেই মণি নিয়ে যাত্রা করলে তবে হারানাে রাজকন্যাকে খুঁজে পাবে।
ব্যঙ্গমী আস্তে-আস্তে স্বর নীচু করে বৃলে-তা তাে বটেই। রাজকন্যাকে তাে জল-দৈত্য চুরি করে লুকিয়ে রেখেছে এই মহা-অরণ্যেরই সাতরঙা হ্রদের জলের তলায়। সে হ্রদের জল সকালবেলায় থাকে নীল সােনালী রং, দুপুরবেলায় হয় রূপাের রং আর ইস্পাতের রং, বিকেলবেলায় ময়ূরকণ্ঠী, আর সন্ধ্যাবেলায় হয় আবীর কুমকুম গােলা। রাত্রির অধারে কিন্তু সেই জলই হয়ে ওঠে কালির মত কালো, নিকষ-নিতল !
রাজকন্যা অরণ্যে এসেছিলেন বসন্তের ফুল তুলতে সখীদের সঙ্গে। সাতরঙা হদের জলে নেমে হাত বাড়িয়ে যেই লাল পদ্মফুল তুলতে গেলেন,জলদৈত্য
এসে তাকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেল জলের তলার পাতালপুরীতে। ব্যাঙ্গমা ফি ফিস করে বলে এই হ্রদের জলের তলায় পাতালপুরীতে যাওয়া যেতে পারে একমাত্র ফণীর মণির আশ্চর্য আলােয়। লক্ষ ঝুলি যদি তপস্যায় তুষ্ট হয়ে কালনাগকে তার মাথার মণি মাটিতে ফেলে দেওয়ার আদেশ দেন তাহলে রাজপুত্তুর হারানাে ছােটবােন পেলেও পেতে পারেন।
আকাশ সাদা হয়ে ভাের হয়ে এলাে। বাসা ছেড়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী উড়ে চললাে
উত্তর সাগরের মুখে।
লক্ষঝুরির সাতশাে মহল প্রাসাদের এক কোণে বাস করে দুগগা টুনটুনি পাখির কথা ওর কাছে, ওর বার্তা তার কাছে টুন-টুন করে লাগানােই ছিল তার একমাত্র কাজ আর আনন্দ। সে রাত্রিবেলায় সন্তর্পণে কান পেতে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সমস্ত কথা শুনে নিয়েছিল। ভাের হতে না হতে দুর্গা টুনটুনি উড়ে চললাে কুঠো ঠোটে ধরে সেই ধবল পাহাড়ের দিকে, যেখানে বিজন দেশের রাজপুত্তুর বামহাতে হীরামুখী বর্শা আর ডানহাতে সােনার তরােয়াল নিয়ে খুঁজে ফিরছেন হারানাে রাজকন্যাকে।
উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে কত মাঠ—কত নদী পার হয়ে দুগগাে টুনটুনি এসে পৌছালাে ধবল পাহাড়ের শিখরে।
ধবল পাহাড়—ধবল পাহাড় শুধু তুষারের রাশি—বরফের স্তুপ। সবুজের লেশ নেই রঙের রেশ নেই। ঝরণাগুলি ঝরছে গলানো তুষার ধারায় ঠিক যেন হিমেল দুধের ধারা। রাজপুত্তুর তখন শিখর পার হয়ে নেমে চলেছেন অন্য রাজ্যে- আরেক রাজার দেশে। নীল ঘােড়ার ক্ষুরে—সোনার নালে—তুষার রাশি খােলায়
খৈ-ভাজার মতই ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠছে। দুগ্গা টুনটুনি উড়ে এসে বসলাে রাজপুত্র কাধে। রাজপুত্র চমকে
তরবারি খুললেন। দুর্গা টুনটুনি রাজপুত্তুরের কানের মধ্যে মুখ দিয়ে বলে উঠলো.ভয় পেয়াে । আমার নাম দুর্গা। একের খবর অন্যের কাছে পৌছে দিই বলে সবাই নাম দিয়েছে টুনটুনি। সকলেই আমাকে ডাকে দুর্গো টুনটুনিরাগ হলে লােকে গাল দেয় দুর্ঘটন টুনি।
রাজপুত্তর রাগ করে বললেন' এখানে আমার কাধে চড়ে বসেছ কোন্ দুর্ঘটন ঘটাতে শুনি?
টুনি বললে আমার নাম তুমি যদি শুভ টুনটুনি করে দাও, তা হলে তােমার
হারানাে বোনকে পাইয়ে দিতে পারি।
রাজকুমার ব্যগ্র হয়ে বললেনএমন সুঘটন যদি ঘটাতে পারাে, তােমার নাম দেবো আমি—সোনার টুনটুনি। টুনি হেসে তখন টুন টুন টুন টুন করে রাজপুত্র কানে কানে ব্যাঙ্গমা
ব্যাঙ্গমীর সমস্ত গল্পটি বললাে।
রাজপুত্তুর বললে এখনি যাবাে আমি তােমার সঙ্গে তােমাদের অরণ্যের অধিপতিকে তপস্যায় তুষ্ট করতে। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো। টুনটুনি রাজপুত্র পথ চিনিয়ে নিয়ে এল নিজেদের অরণ্যে। রাজপুত্র লক্ষঝুরির তলায় দাঁড়িয়ে নিজের চারিধারে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে উর্ধ্ব আকাশে তাকিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। আহার নেই, শয়ন নেই, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। ঠায় একভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনদিন তিনরাত্রির স্থলে ছয়দিন ছয় রাত্রি কেটে গেল। সাতদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা লক্ষঝুরি মহাবট সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর আশ্রিতা প্রজা কালফণীকে আদেশ দিলেন, তার মাথার মাণিক ফেলে দিতে। কালফণী মাটিতে মাণিক ফেলতেই রাজপুত্তুরের চারিপাশের জুলন্ত অগ্নি নিবে গিয়ে তার বদলে রাশি রাশি সুরভি ফুল ফুটে উঠলাে। সারা অরণ্য জ্যোৎস্নার চেয়েও শীতল স্নিগ্ধ অথচ উজ্জ্বল এক আশ্চর্য আলােয় হেসে উঠবে।
মাণিক কুড়িয়ে নিয়ে রাজপুত্র ছুটে চললেন সাতরঙা হ্রদের পানে। মাণিকের আলােয় অরণ্যের কাটাবন ঘনবন ফাক হয়ে গিয়ে সুন্দর পথ আপনা আপনি জেগে উঠতে লাগলাে।
হ্রদের ধারে পৌছে রাজপুত্র দেখতে পেলেন, জলের মাঝে শত-শত পদ্মফুল ফুটে আছে। মাণিকের আলােয় সেই পদ্মফুলগুলি অনেকগুণ বেশী প্রকাণ্ড দেখাতে লাগলাে। রাজপুত্র অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখলেন, সেই সব পদ্মের বুকের ভিতর দিয়ে থরেথরে সরু সিড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে ধাপের পর ধাপে। রাজপুত্র হাতের মুঠোয় মণি চেপে হ্রদের জলে ঝাপ দিলেন। সাঁতার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটি প্রকাণ্ড পদ্মফুলের উপরে উঠে দেখলেন মৃণালের মধ্য দিয়ে
পাতালপুরীর তলায় দিব্যি সরু সিঁড়ি। মণিহাতে রাজপুত্র সেই সিঁড়ি বেয়ে তন্তর করে নেমে চলে গেলেন পাতালপুরীর মধ্যে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন, স্ফটিকেরই ঘরে স্ফটিকের খাটে
স্ফটিকের বালিশ মাথায় দিয়ে তাঁর হারানাে ছােটবােনটি গালে হাত রেখে শুয়ে শুয়ে কাদছে! তার চোখের অশ্রু বিন্দুগুলি স্ফটিকের মালার মতন দেখাচ্ছে। জল-দৈত্যকে হীরামুখী বর্শায় বিধি বধ করে-রাজকুমার উদ্ধার করে বাবা- মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজপুত্রের যে বেশী সময় লাগেনি, তােমরা নিশ্চয়ই অনুমান করে নিতে পারবে। তাই এইখানেই আমার কথাটি ফুরালাে।
No comments:
Post a Comment