জাদু আংটি
রবিদাস সাহারায়
মকুম পুরের রাজার দুই ছেলে রতনকুমার ও রজতকুমার। রাজা মারা কু যাওয়ার পরে বড়ছেলে রতনকুমার সিংহাসনে বসল। দু'জন তাে আর সিংহাসন পেতে পারে না, তাই ছােট ভাই রজতকুমার পেলে অনেক ধনসম্পত্তি। রতনকুমার পেল রাজছত্র। রতনকুমারের গায়ে যেমন শক্তি মাথায় তেমন বুদ্ধি। বেশ ভালােভাবেই সে রাজ্য চালাতে লাগল।
প্রজাদের সুখ সুবিধার দিকে তার খুব দৃষ্টি। তাই প্রজারাও তার ধন্য ধন্য করতে লাগল। কিন্তু ছােট ছেলে রজতকুমার বড় বেহিসাবী, আর কেমন যেন ছন্নছাড়া। যখন যা খুশী তাই করে আর যখন যেখানে খুশী ঘুরে বেড়ায়।
কোন কিছুর হিসেব নেই। দুহাতে খরচ করে ধনসম্পত্তি সব উড়িয়ে দেয়। রাজা মারা গেছেন, কিন্তু রাণী আছেন তখনাে বেঁচে। তিনি ছোট ছেলের এই ভাবগতিক দেখে মনে মনে ভয়ানক দুঃখ পান।
গােপনে চোখের জল ফেলেন। রজতকুমারকে ডেকে একদিন রাণীমা বললেন রজত, একটু বুঝে শুনে
চ বাবা। কতদিন বা বাঁচবাে। কিন্তু তাের ভবিষ্যৎ কি হবে? তাের কথা ভেবে রাতে আমার ঘুম হয় না। শান্তিতে আমাকে মরতে দে।
রজতকুমার সুবােধ ছেলের মত মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, আচ্ছা আমি ভালােভাবে চলবাে মা। কয়েকদিন একটু ভালােভাবেই চলল রজতকুমার। কিন্তু কথায় বলে, স্বভাব না যায় মরলে, কয়লা সাফ হয় না ধুলে। কিছুদিন যেতে না
যেতেই রজত আবার নিজের মূর্তি ধরল। বন্ধুদেব সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ফুর্তি করে বেড়ায়, আর দুহাতে টাকা ওড়ায়। অল্পদিনের মধ্যেই রজতকুমার ফতুর হয়ে পড়ল। তার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে
উঠল রাজ্যের লােক। তখন রজতকুমাবের ইশ হল। সে মায়ের কাছে এসে বলল, মা, আমাকে টাকা দাও। আমি বিদেশে বাণিজ্য করতে যাবে। 1. রাণীমা বলেলেন, তাের কি কম টাকা ছিল? সব তাে নষ্ট করলি। লাখ লাখ টাকা দিলেও তুই কিছু করতে পারবি না। বুদ্ধি আর ভাগ্য থাকলে লােকে খালি হাতেও অনেক কিছু করতে পারে।
মা কিছুই দিলেন না। তখন একদিন মনের দুঃখে রজতকুমার কাউকে কিছু বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। তখন তার হাতে মাত্র চারটি মােহর। পথ চলতে চলতে রজ্ত ভাবতে লাগল, মা বলেছে বুদ্ধি আর ভাগ্য থাকলে নাকি অনেক
কিছু করা যায়। আচ্ছা দেখি আমি কি করতে পারি। কিছুদূর যেতেই রজতকুমার দেখতে পেল একজন লােক একটি বিড়াল নিয়ে কোথায় যেন চলেছে। রজতকুমার তাকে জিজ্ঞেস করল, বেড়ালটি কি করবে? লােকটি বলল, বিক্রি করব।
রজত কুমার ভালো ইস্ বেড়ালটিকে বেঁধে রেখে লােকটি কি কষ্টই না দিচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করল, কত দামে বিক্রি করবে?
লোকটি বলল, একটি মােহর পেলেই আমাকে দিয়ে দেবাে। রজতকুমার তখনই একটি মােহর দিয়ে কিনে নিল বেড়ালটি। নিয়ে একটা কুটীরের কাছে সেটিকে ছেড়ে দিল। ভাবল, ঐ বাড়িতে গিয়ে ভাত মাছ খেয়ে বাঁচতে পারবে। বেড়ালটি কিন্তু চলে যেতে চাইল না। মানুষের মত ভাষায় বলে উঠল, রাজকুমার, আমাকে
তােমার সঙ্গে নাও। আমি যখন পারি তােমার উপকার করব। রজতকুমার ভাবল, ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার তো! বিড়াল মানুষের মত কথা এমন কথা বলছে
বলে। কিন্তু বিঙল আবার তার কি উপকার করবে? তবু যখন 1. তখন দেখাই যাক না। তাই বেড়ালটিকে সে সঙ্গে নিয়ে চলল।
তারপর.চলতে চলতে দেখল একজন লােক একটি কুকুর নিয়ে যাচ্ছে, তাকে জিজ্ঞেস করল রজতকুমার, এটা নিয়ে কি করবে? লােকটি বলল, বিক্রি করব।
রজতকুমার বলল, আমি কিনব। বেচবে আমার কাছে? লােকটি বলল নিশ্চয়ই।
কত চাও?
একটি মােহর পেলেই আমি বেচতে পারি।
রজতকুমার একটি মােহর দিয়ে কুকুর কিনে নিল।কি তার অদ্ভুত খেয়াল। কিছুদুরে গিয়েই ছেড়ে দিল ককুরটিকে। কুকুরটি কিন্তু ছাড়া পেয়ে গেল না। মানুষের মত গলায় বললে, রাজকুমার, আমি তােমার সঙ্গে থাকব। দরকার হলে উপকার করব তোমার।
রজতকুমার ভাবল, কুকুর কথা বলছে। মজার ব্যাপার তাে। কিন্তু কুকুর আবার তার কি উপকার করবে? তবু কি ভেবে বলল আচ্ছা থাক।
কুকুর আর বেড়ালটিকে নিয়ে রজতকুমার পথ চলতে লাগল। পথের বাঁক ঘুরতে দেখতে পেল একটি ছেলে চলছে একটি পায়রা নিয়ে। পায়রাটা ধবধবে সাদা।
পায়রা দেখে রজত কুমারের খুব পছন্দ হল। তাই জিজ্ঞেস করল, পায়রা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? ছেলেটি জবাব দিল,চলেছি বাজারে বিক্রি করতে। রজতকুমার বলল, তােমাকে একটি মােহর দিচ্ছি ওটা আমাকে দিয়ে দাও না।
1.
ছেলেটি তো মহাখুশী। ছােট একটা পায়রার এত দাম পাবে তাই সে ভাবতে পারেনি। সে তখনই একটা মােহর নিয়ে পায়রাটি রজতকুমারকে দিয়ে দিল। রজতকুমার পায়রাটিকে ছেড়ে দিল আকাশের দিকে। কিন্তু পায়রাটি একটু উড়ে গিয়ে আবার ফিরে বসল রজতকুমারের কাধে। মানুষের মত ভাষায় বলে উঠল রাজকুমার আমি তােমার সঙ্গে থাকব।
পশুপাখীদের কাণ্ডকারখ না দেখে তাজ্জব বনে গেল রজতকুমার, আগে তো কোনদিন তাদের মুখে কোন থা সে শুনতে পায়নি। তবে কি তার ভাগ্য খুলে গেল?
রজতকুমার বলল বেশ থাকো। এই বলে সে পায়রাটিকে কাধে নিয়েই পথ চলতে লাগল। তার কাছে ছিল একটা মােহর। তিনটি মােহর খরচ হয়ে গেল। আর
বাকী রইল মাত্র একটি মােহর।
চলতে চলতে পথে দেখা হল এক সাপুড়ে সঙ্গে। সাপুড়ের ঝাপি মাথায় নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে—সাপ নেবে, সাপ?
রজতকুমার ভাবল, এ আবার কেমন কথা? সাপও আবার কেউ বেচে নাকি?
তার মাথায় কি ঝোক চাপল। সে জিজ্ঞেস করল সাপটি বেচবে আমার কাছে?
সাপুড়ে বলল একটি মােহর পেলেই বেচতে পারি। রজতকুমার তার শেষ সম্বল মােহরটি দিয়ে কিনে নিল সাপটি। কিন্তু তার পরেই ভাবল, এটা দিয়ে করবাে কি? সঙ্গে থাকলে বিপদই বাড়বে।
পথের পাশেই ছিল একটি ঝােপ। সেই ঝােপের কাছে গিয়ে সাপটিকে সে
ছেড়ে দিল। সাপটি কিন্তু গেল না। মানুষের মতই বলে উঠল, রাজকুমার, সাপুড়ের কাছ থেকে উদ্ধার করে তুমি আমাকে খুব উপকার করেছ। আমাকে তােমার সঙ্গে রাখাে। সুযােগ পেলে তােমার উপকার কব। রজতকুমার অবাক হয়ে গেল সাপের
কথা শুনে। ভাবল, সাপ আবার তার কি উপকার করবে? তবু কি ভেবে সেটিকে
রেখে দিল। এবার তার কাছে একটি বিড়াল, একটি কুকুর, একটি পায়রা এবং
একটি সাপ। কিন্তু একটি পয়সাও রইল না তার কাছে। সে নিজেই বা কি খাবে আর এইসব প্রাণীদের ক খেতে দেবে? ঝোঁকের মাথায় এতক্ষণ কিছুই সে খেয়াল করে নি। এবার তার খেয়াল হল।
কিভাবে পয়সা রােজগার করা যায় তার ফন্দি খুঁজতে লাগল রজতকুমার। কিন্তু কিছুতেই কোন সুবিধা করতে পারল না। দু'দিন প্রায় না খেয়েই দিন কাটল। রজতকুমারের এই অবস্থা দেখে সাপটির মনে খুব দুঃখ হল। সে বলল, রাজকুমার, তুমি চলাে আমার সঙ্গে। আমার বাবা তােমার একটা কিছু উপায় করে
দেবেন।
সাপের কথায় মনে একটু ভয় হল রাজকুমারের। কোথায় যাবে সে সাপের সঙ্গে? রজতের মনের কথা বুঝতে পেরে সাপটি বললতােমার কোন ভয় নেই। আমার বাবা সাপের রাজা। তিনি তােমার কোন অনিষ্ট করবেন না।
রজতকুমার সাপের কথায় বিশ্বাস করে তার সঙ্গে যেতে লাগল। অনেক
দূরে একটু জঙ্গলের ভেতর গিয়ে ঢুকল সাপটি। রজতের বুক কাপতে লাগল।
সাপটি বলল, ভয় নেই আমার সঙ্গে চল।
গভীর বনের ভেতর সর্পরাজ্য। সাপের রাজা সব শুনে রজতকুমারের উপর খুশী হুল। তাকে একটি আংটি দিয়ে রাজা বললএটি জাদু আংটি। খুব যত্ন করে
রাখবে। মাথায় তিনবার ঘষে এটার কাছে যা চাইবে তাই পাবে। কিন্তু সাবধান, দরকার ছাড়া কিছু চাইবে না।
রজতকুমার তাতেই রাজী হল। এবার সাপটা বলল রাজকুমার, আজ থেকে আমার ছুটি।
সাপকে বিদায় দিয়ে রজতকুমার বেরিয়ে এলাে বন থেকে। পথে যেতে
যেতে ভাবল আমার সঙ্গে তাে কানাকড়িও নেই। আমি আংটির কাছে এক থলি মােহর চাই না কেন? তখন রজতকুমার আংটিটাকে তিনবার মাথায় ঘযে বলল, আমাকে এক
থলি মােহর দাও।
কথা বলতে না বলতেই ঝপ করে একথলি মােহর তার সমানে পড়ল। তা দেখে রজতকুমারের কি আনন্দ! বা ভারী মজা তাে। মনের খুশীতে পথ চলতে লাগল রজতকুমার। কিন্তু পথ চললেই তাে হবে
। ভয়ানক খিদে পেয়েছে। সঙ্গে আছে আরাে তিনটি প্রাণী—বেড়াল, কুকুর ও
পায়রা। ও দেওর নিশ্চয় খিদে পেয়েছে খুব।
জনহীন পথ—কাছাকাছি কোন বাড়িঘর নেই, খাবার কোথায় মিলবে?তখন
হঠাৎ খেয়াল হল আন্টির কাছে খাবার চাই না কেন!
তখন আংটিটি মাথায় তিনবার ঘরে বলল, আমাদের খাবার দাও। কি আশ্চর্য ব্যাপার। বলতে না বলতেই চারথালা খাবার তাদের সামনে এসে হাজির হল। তার জন্য একরকম খাবার, আর তিনটি প্রাণীর জন্য তিনরকম। অবাক হয়ে গেল
রজতকুমার। এসব কেমন করে হয় ?
সবাই মনের আনন্দে পেটপুরে খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার সে
চলতে লাগল। সামনের দিকে।
তখনও সন্ধ্যা হয়নি। চলতে চলতে সে একটি নগরীর সামনে এসে পৌছল। নগরীতে ঢুকবার মুখেই রাজবাড়ির তােরণ। তােরণে পা দিয়েই দেখতে পেল রাজার প্রহরী বিরাট এক নাকারায় ঘা দিয়ে কি যেন ঘােষণা করছে। সে আরাে কাছে এগিয়ে গেল।
শুনল, প্রহরী বলছে এক রাতের মধ্যে সমুদ্রের মাঝখানে যে সােনার প্রাসাদ তৈরী করে দিতে পারবে সে অর্ধেক রাজত্ব পাবে আর পাবে রাজকন্যা।
কিন্তু যে রাজী হয়েও করে না দিতে পারবে তার মুণ্ড কেটে ফেলা হবে। একি আজগুবি কথা! রজতকুমার মনে মনে কি যেন ভাবল। তারপর গিয়ে
হাজির হল রাজদরবারে। রাজার কাছে গিয়ে বলল মহারাজ, আমি পারব সমুদ্রের উপর প্রাসাদ তৈরী করতে।
রাজা সেকথা শুনে অবাক। বললেন, তােমার বয়স অল্প, কেন সাধ করে নিজের মরণ ডেকে আনছাে? কত রাজা মহারাজা বীরপুরুষ রাজী হয়েও এ কাজ করতে পারে নি। তারা জীবন দিয়েছে। কেন তুমি মিছেমিছি প্রাণ দেবে? রজতকুমার বলল, মরণকে আমি ভয় করিনা। তাই একবার চেষ্টা করে
দেখতে চাই।
রাজা বললেন, বেশ, তা হলে আজকেই কাজে লেগে যাও। আজ রাত্রের মধ্যেই সোনার প্রাসাদ তৈরী করা চাই। ভার হওয়ার পর যদি দেখা যায় সােনার
প্রাসাদ তৈরী হয়নি তবে তােমার মুণ্ড কেটে দেওয়া হবে। রজতকুমার রাজী হয়েও দুরুদুরু বুকে সমুদ্রের পাড়ের দিকে রওনা হল। রাজা কয়েকজন প্রহরী সঙ্গে দিয়ে বললেন, দেখবে ছেলেটি যেন গালিয়ে না যায়। সন্ধ্যা হয়ে এল। চারিদিকে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। প্রহরীরা ভাবল, রজতকুমার
এবার কাজ শুরু করবে। কিন্তু একি! সমুদ্রের ধারে চুপ করে বসে রইল রজতকুমার। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরই সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়ল। প্রহরীরা ভাবাল, ছেলেটা নিশ্চয়ই পাগল। নইলে এমন কঠিন কাজের ভার নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে? মিছিমিছি ওর মুণ্ডুটা যাবে।
রাত দুপুর হয়ে এল, তবু রজতকুমার জাগল না। তখন প্রহরীরাই পড়ল ঘুমে কাবু হয়ে। ঠিক সেই সময়েই জেগে উঠল রজতকুমার। আংটিটাকে তিনবার মাথায় ঘষে বলল—সমুদ্রের মাঝখানে সোনার প্রাসাদ তৈরী করে দাও। কি আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের জল যে তােলপাড় হতে লাগল। আর
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে গড়ে উঠলাে এক সোনার রাজপুরী, পরদিন ভােরবেলায় ঘুম ভাঙতেই প্রহরীরা চমকে উঠল। অবাক হয়ে দেখল, সমুদ্রের মাঝখানে কচি রােদের আলােয় ঝকমক করছে সােনার প্রাসাদ। তারা ছুটে রাজাকে খবর দিতে গেল।
রাজা প্রহরীদের কথা মােটেই বিশ্বাস করতে পারলেন , মন্ত্রীরাও কেউ বিশ্বাস করলেন না তাদের কথা। একি কখনাে সম্ভব হতে পারে? কিন্তু সমুদ্রের তীরে এসে যখন স্বচক্ষে দেখলেন, তখন আর অবিশ্বাস করার কোন
কারণ রইল না
এতদিন কোন দেশের রাজকুমার যা পারে নি, কোন বীরপুরুষ যা পারে নি তা পারল রজতকুমার। রাজাকেও তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে হল। রাজকন্যা তরঙ্গ মালার বিয়ে দিলেন রজতকুমারের সঙ্গে আর সেই সঙ্গে তাকে উপহার দিলেন অর্ধেক রাজত্ব।
সেই সােনার প্রাসাদটিও জামাইকে যৌতুক হিসাবে দান করলেন রা। রজতকুমার বলল, এই প্রসাদে আমি বাস করতে রাজী আছি। কিন্তু একটি সর্ত আছে।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কি সর্ত?
কুকুর, বিড়াল আর পায়রা, এই তিন সঙ্গীকে প্রাসাদে ঠাই দিতে হবে।
রাজা তাতেই রাজী হলেন। রজতকুমার তরঙ্গমালাকে আর তিনসঙ্গীকে নিয়ে সেই সোনার প্রাসাদে বাস
করতে লাগল। বেশ সুখেই কাটতে লাগল তারে দিন। সমুদ্রের মাঝখানে রাজপ্রাসাদ, সময় আর কাটতে চায় না। তাই নৌকা করে
রজতকুমার মাঝে মাঝে শিকার করতে বের হয়। সেই শিকারের সঙ্গী হয় কুকুর।
শিকারের বস্তুকে খুঁজে বার করার ক্ষমতা কুকুরের অতি অদ্ভুত। তাই রজতকুমারের সুবিধা হয় খুব। সূর্য মাথার ওপর উঠবার আগেই সে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে সন্ধ্যা হবার একটু আগে। এভাবে মাঝে মাঝেই শিকারে যায় রজতকুমার। বিড়াল আর পায়রাটিকে
প্রসাদেই রেখে যায়। রাজকন্যা তরঙ্গমালা একলা থাকে—বিড়াল আর পায়রার
সঙ্গে খেলা করে তবু সময়টা কাটে ভাল। বেড়াল, কুকুর, আর পায়রা সবাই কথা বলতে পারে এটা জানতে পেরে তরঙ্গমালার অবাক হবার শেষ নেই। কিন্তু রজতকুমারের নিষেধ, তাই সেকথা কাউকে সে জানায় না।
একদিন শিকার থেকে ফিরে এসে রাজকুমার দেখল তরঙ্গমালা মুখ ভার করে বসে আছে। রজতকুমার শুধাল, কি হয়েছে তােমার? মুখে হাসি নেই কেন? তরঙ্গমালা বলল—সোনার প্রাসাদ তাে তৈরী করেছ তুমি। আমার মাথার চুলগুলিকে যদি সোনার করে দিতে পারাে তবেই আমার মুখে হাসি ফুটবে, নইলে নয়।
রজতকুমার বললে এই কথা! বেশ! আজরাত্রেই তােমার চুল সোনার করে দেবাে।
তখন গভীর রাত। রজতকুমার তিনবার নিজের মাথায় আংটিটা ঘষে বললে রাজকন্যার মাথার চুল সব সোনার করে দাও। পরদিন ভােরে ঘুম থেকে উঠে তরঙ্গমালা দেখল সত্যি তার মাথার সব চুল
সােনার হয়ে গেছে। তা দেখে তরঙ্গমালার কি আনন্দ। তার মুখে হাসি আর ধরে ।
একদিন হলাে কি, তরঙ্গমালা চুল আঁচড়াচ্ছে, হঠাৎ দুটি চুল ছিড়ে চিরুণীতে
আটকে গেল। এমন সুন্দর চুল, ফেলে দিতে মায়া হল তরঙ্গমালার। কি করবে তাই ভাবতে লাগল। আগের দিন শিকার করে ফেরার পথে রজতকুমার নিয়ে এসেছিল একটি সুন্দর গাছের ডাল।
সেই ডালের থেকে একটি পাতা ছিড়ে তরঙ্গমালা তৈরী করলাে একটি ছােট্ট নৌকো। তারপর সেই নৌকোয় ভরে চুল দুটি ভাসিয়ে দিল সমুদ্রের জলে।
পাতার নৌকা ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌছল অন্য এক রাজ্যে। সেই রাজ্যের নাম পাহাড়গড়। নদীর ধারেই সেই রাজ্য। এক ধোপা কাপড় কাচছিল, তার চোখে পড়ল সেই জিনিস। সােনার চুল সে জীবনে দেখেনি, তাড়াতাড়ি সেই চুল নিয়ে
চলল সেই দেশের রাজার কাছে। রাজাও চুল দেখে অবাক তিনি ধােপাকে বকশিশ দিয়ে বিদায় করলেন। কেম; করে সেই চুলের কথা চারিদিকে রটে গেল। সেই আশ্চর্য্য জিনিস দেখবার জন্য ভিড় জমে গেল রাজদরবারে। রাজ্যের কত লোক দেখলাে সেই চুল,
দেখল পাহাড়গড়ের রাজার ছেলে মােহনলালও। অমনি সে পণ করে বসল এই
সোনার চুল যার মাথায় সেই মেয়েকে আমি বিয়ে করব। সেদিন থেকে কি হল মােহনলালের, সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। সােনার পালঙ্ক ছেড়ে ঘুমুতে লাগল ছেঁড়া ময়লা বিছানায়।
রাজা তা জানতে পেরে চিন্তায় আকুল হলেন। কোথায় তিনি খুঁজে পাবেন সােনার চুলের কন্যাকে? মন্ত্রীদের কাছে তিনি বুদ্ধি চাইলেন, দেশের বড় বড় পণ্ডিতদের ডাকলেন।
কেউ কোন কিছু ঠিক করতে না পেরে শেষে পরামর্শ দিলেন মায়া বনের ডাইনী বুড়ীকে ডাকুন, সে-ই খুঁজে দিতে পারবে সেই কন্যাকে। মায়া বন থেকে ডাইনী বুড়ীকে নিয়ে আসা হল। সব কথা শুনে সে বলল
মহারাজ, আমি সেই কন্যাকে খুঁজে দিতে পারি। তবে আমি যা বলব তাই হবে।
করতে
রাজা বললেন, হ্যা তাই করব। বলে কি করতে হবে? ডাইনী বুড়ি বললআমার সঙ্গে দিতে হবে ময়ূরপঙ্খী নাও আর তাতে চারজন খুব পাকা মাঝি। রাজা তাই দিলেন। ময়ূরপঙ্খী ভাসল জলে। ডাইনী বুড়ী মাঝিদের নৌকা চালিয়ে দিতে বলল সেদিকে—যেদিকে থেকে ভেসে এসেছিল সেই চুল।
ময়ূরপঙ্খী নাও চলল ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে গিয়ে তারা দেখতে পেল সোনার রাজপ্রাসাদ। ডাইনী বুড়ীর বুঝতে বাকী রইল না। ঐ সােনার রাজপুরীতেই আছে সোনার চুলের রাজকন্যা। ডাইনী বুড়ী বলল মাঝিরা, রাজপুরীর পেছন দিকে নৌকা ভিড়াও।
মাঝিরা তাই করল। ডাইনী বুড়ী মাঝিদের খুব সাবধানে থাকতে বলে চুপি চুপি গিয়ে ঢুকল সােনার প্রাসাদে। একাই চুপি চুপি ভিতরে গিয়ে দেখল সোনার পালঙ্কে চুপ করে বসে আছে তরঙ্গমালা তার মাথায় সোনার চুল। ডাইনী
বুড়ী এগিয়ে গেল তার কাছে। কন্যার গালে আদরের চুমাে খেয়ে বলল--আমাকে চিনতে পারছ না, আমি যে তােমার মাসি হই।
তরঙ্গমালা বলল—না, আমি তাে তােমাকে কোনদিন দেখেনি। তােমার
কথাও শুনিনি কোনদিন।
ডাইনী বুড়ী বললে, কি করে দেখবে আমাকে, আমি যে থাকতাম বিদেশে। তােমাকে সেই ছােটবেলায় দেখেছি। তােমাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছি। তুমি ছিলে আমার কত আদরের। তরঙ্গমালা ডাইনী বুড়ীর কথায় বিশ্বাস করল। বলল, যে তােমাকে পেয়ে
ভালই হল। আমি একা থাকি, তুমি কয়েকদিন থেকে যাও আমার এখানে। রজতকুমার তখন রাজপুরীতে ছিল না। গিয়েছিল নৌকো নিয়ে শিকার করতে।
ডাইনী বুড়ী তরঙ্গমালার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। কথায় কথায় বলল, দেখাে, আমি তােমার কাছে থাকতে রাজী আছি। তবে আমার কথা কাউকে জানাবে না। আমি শুধু তােমার সঙ্গেই কথা বলব, আর কারুর সঙ্গে নয়।
তরঙ্গমালা তাতেই রাজী হল। ডাইনী বুড়ী দু'দিন সেখানে থেকে রজতকুমার
কখন বাড়িতে থাকে কখন বেরিয়ে যায় সব জেনে নিল। রজতকুমারের হাতে জাদু
আংটির আশ্চর্য্যগুণের কথাও জেনে নিল সে! তখন খুব মায়া দেখিয়ে বলল, আহা তরঙ্গমালা, তুমি একা এই সমুদ্রের মাঝখানে থাকো, যদি কোন বিপদ-আপদ হয় তখন কি হবে? তােমার স্বামীর কাছ থেকে আংটিটা চেয়ে নিয়ে তুমি নিজের কাছে রেখে দিও।
সাবধান, আমার কথা যেন বলাে না। তরঙ্গমালা ভেবে দেখল কথাটি মন্দ নয়। তাই পরের দিন যখন রজতকুমার শিকার করতে বেরুবে সেই সময়ে সে বলল, তােমার হাতের আংটিটা আমাকে
দিয়ে যাও। রজতকুমার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি আংটিটা দিয়ে করবে কি? তরঙ্গমালা বলল আমি সারাদিন একা থাকি, যদি কোন বিপদ হয় তখন কি হবে? তুমি আমাকে আংটিটা দিয়ে যাও। আমি জানতে পেরেছি এটার অনেক
গুণ। রজতকুমার আর কি করবে! আংটিটা তরঙ্গমালার হাতে পরিয়ে দিয়ে শিকারে চলে গেল। কিন্তু কি ভাবে কি করতে হয় তা বলল না।
ডাইনী বুড়ী ভাবল এই সুযােগ। দুপুর বেলা তরঙ্গমালাকে সে বলল-রাজকন্যা, তুমি ঘরের ভিতর বসে থাকো কিছুই তো দেখা না। তােমাদের বাড়ির পেছনে বাধা আছে ময়ূরপঙ্খী নৌকো। ৩,কি দেখেছ কখনাে? চলাে সেই নৌকায় চড়ে বেড়িয়ে আসি।
বেড়াবার কথা শুনে তরঙ্গমালা আহ্লাদে আটখানা। সে তখনই ডাইনী বুড়ীর সঙ্গে চলল ময়ুরপঙ্খী নৌকা চড়তে। বাড়ির পেছনে বাধা ছিল নৌকোটি রঞ্জতকুমারের চোখে তা পড়ে নি। তরঙ্গমালা ময়ূরপঙ্খী চড়তেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকো ছৈ
সোঁ করে ছুটে চলল পবনের বেগে।
তরঙ্গমালা বুঝতে পারল সে কত বড় ভুল করেছে। কিন্তু তখন আর ফিরে যাবার উপায় নেই। কান্নাই শুধু তার সার হল। ময়ূরপঙ্খী গিয়ে পৌছল সেই রাজার দেশে। খবর রটে গেল সোনার চুলের কন্যাকে নিয়ে ডাইনী বুড়ী ফিরে এসেছে। তখন সেখানে কি আনন্দ-কি ধুমধাম।
রাজার ছেলে মােহনলালের সঙ্গে তরঙ্গমালার বিয়ের আয়ােজন চলতে লাগল। যতদিন বিয়ে না হয় ততদিন তরঙ্গমালাকে রাখা হল ডাইনী বুড়ীর পাহারায়।
ডাইনী বুড়ী তাকে দিনরাত কড়া ভাবে পাহারা দিতে লাগল। এদিকে রজতকুমার শিকার থেকে ফিরে এসে দেখল রাজপুরী শূন্য। তরঙ্গমালার নাম ধরে সে ডাকল অনেকবার, কিন্তু কোন সাড়াই পাওয়া গেল না।
পায়রাটি উড়ে এসে বলল, প্রভু রাজকন্যার মাসী এসেছিল এখানে, ময়ূরপঙ্খী নৌকায় চড়িয়ে তাকে নিয়ে সে চলে গেছে। সে কথা শুনে রাজকুমার গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। তা দেখে পায়রাটি
বলল, দুঃখ করাে না, দেখি আমি উড়ে গিয়ে রাজকন্যার কোন খবর আনতে পারি
কিনা।
বেড়াল বললাে, আমিও যাবাে তােমার সঙ্গে। দেখি যদি তােমার কোন সাহায্য করতে পারি। বিড়াল কাধের উপর তুলে পায়রাটি উড়ে চলল। কুকুর রইল গ্রাসাদে
রজতকুমারের সঙ্গে। উড়তে উড়তে তারা এল সেই রাজ্যে। যেখানে তরঙ্গমালাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। পায়রাটি জানালা গলিয়ে তরঙ্গমালার কাছে গিয়ে বসলো।তখন ডাইনী
বুড়ী কাছে ছিল না।তরঙ্গমালা পায়রাটিকে দেখতে পেয়েই চিনতে পারল। জিজ্ঞেস করল, রজতকুমার কেমন আছে? তার কোনো বিপদ হয়নি তাে?
শায়রা বলল, না, তিনি ভালই আছেন। তুমি কেমন আছো? তরঙ্গমালা তখন কেঁদে কেঁদে নিজের দুঃখের কাহিনী সব কিছু বলল
পায়রাটিকে। পায়রাটি জিজ্ঞেস করল, জাদু আংটিটা কোথায়? তরঙ্গমালা বলল, সেটি ডাইনী বুড়ি সব সময় নিজের কাছে রেখে দেয়। আর ঘুমােবর সময় রেখে দেয় মুখের মধ্যে। তাহলে উপায়?
বেড়ালের সঙ্গে পায়রা অনেক কিছু পরামর্শ করল। এমন সময় ঘরের এককোণে দেখতে পেল কয়েকটা ইঁদুরের গর্ত। মনে মনে একটা বুদ্ধি এটে বেড়াল তরঙ্গমালাকে বলল, রাজকন্যা, তােমাকে রাত্রে যখন ভাত খেতে দেবে সেই ভাত তুমি সব খাবে না।
কিছুটা ছড়িয়ে দেবে ঐ ইদুরের গর্তের মুখে। তরঙ্গমালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
পায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
বেড়াল বলল, তা পরে বুঝতে পারবে। এখন কিছু বলবাে না। এই বলে
পায়রা বিড়াল নিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রাতের বেলা খাবার এলাে তরঙ্গমালার জন্য। তরঙ্গমালা সব ভাত খেল না।
ডাইনী বুড়ী জিজ্ঞেস করল, কি গাে রাজকন্যা , সব ভাত খেলে না যে? ঐ তরঙ্গমালা বলল, না, আজ খিদে নেই। তারপর একটু থেমে বলল আহা।
ইদুর বেচারীরা সারাদিন না খেয়ে থাকে, আজ ওরা কিছু খা।
এই বলে তরঙ্গমালা কিছুটা ভাত ইদুরের গর্তের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ডাইনী বুড়ী ঘুমিয়ে পড়লাে তরঙ্গমালার পাশে, ঘুমােবার আগে আঁচল থেকে আংটিটা খুলে মুখের মধ্যে রাখতে ভুল করল না।
তরঙ্গমালার চোখে ঘুম নেই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাইনী বুড়ীর নাক
ডাকতে লাগল।
রাত একটু গভীর হতে ইদুরেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এল খাবারের লােভে। তারা খুঁটে খুটে ভাত খেতে লাগলাে আর ঘুরঘুর করে ঘরময় বেড়াতে লাগল।
বেড়াল একটু আড়ালে লুকিয়ে ছিল। সে বেরিয়ে এসে একটি লম্বা লেজওয়ালা ইদুরকে খপ করে ধরে ফেলল। তারপর তার লেজটি ঢুবি য় দিল ডাইনী বুড়ীর নাকের ভেতর।
ডাইনী বুড়ি তখন বেশ আরামে ঘুমুচ্ছিল। ইদুরের লেজ নাকের ভেতর ঢুকতেই বেরিয়ে এল বিরাট হাঁচি-হ্যাচ্চো। অমনি মুখের ভেতর থেকে আংটিটি ছিটকে বেরিয়ে এসে মেঝের ওপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মুম ভেঙ্গে গেল তার। ছুটে
এসে ডাইনী বুড়ী আংটিটা ধরবার আগেই পায়রা এসে ছোঁ মেরে সেটি ঠোটে তুলে নিয়ে উড়ে পাড়িয়ে গেল। বেড়াল আর পায়রারা আগেই তরঙ্গমালাকে বলে রেখেছিল, রাজকন্যা তােমার জন্য আসবে সোনার রথ। তাতে উঠে তুমি কুমকুমপুরে চলে যেও।
তারপরের ঘটনা অতি বিচিত্র। পায়রার পিঠে উড়ে চলল বেড়াল। সােনার
প্রাসাদে গিয়ে রজতকুমারের হাতে জাদু আংটিটি দিল। আংটি পেয়ে রজতকুমার যেন ফিরে পেল হারানাে জীবন। সেটি মাথায় তিনবার ঘষে বলল, সােনার রথে উড়িয়ে তরঙ্গমালাকে এনে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে একটি সোনার রথ এসে হাজির হল সোনার প্রাসাদ অলিন্দে। রজতকুমার বললে, পাহাড়গড় রাজ্যে আছে তরঙ্গমালা তার কাছে যাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই রজতকুমার ফিরে পেল তরঙ্গমালাকে। এবার তারা পরম সুখে বাস করতে লাগল।
No comments:
Post a Comment