নিরীহ দৈত্য
শৈল চক্রবর্তী
কতদিন আগে কেউ জানে না, এক দেশে ছিল এক দৈত্য। তার নাম ছিল কিড়িম্ব। কেউ বলে সে হিড়িম্বার বংশধর। কিড়িম্বর বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিল মানুষের বাস। সে যেখানে থাকত তার ত্রিসীমানায় মানুষ থাকতে পারত না। থাকবেই বা কেমন করে? কিড়িম্বর চেহারা দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। সবচেয়ে সাহসী লােকও তার কাছে যাবার কথা ভাবতে পারত না। কিড়িম্বর মুখখানা ছিল এমনই ভয়ানক, এমনই হিংস্র যে কেউ তার দিকে
তাকাতে পারত না। মুখের ওপর দিকে বড় বড় চুলের ঝাকড়া। আর নিচের দিকে গোঁফ-দাড়ি জঙ্গল! সেই জঙ্গলের মধ্যে কোদালের মত বড় বড় দাঁত। মুখের মাঝখানে একটা ধ্যাবড়া মােটা নাক আর দুপাশে দুটো গােল গােল লালচে চোখ। এইতাে গেল মুখের বাহার! এইবার দেহের কথা বলি, দেহটা ছিল প্রকান্ড। তাকে দাঁড়ানাে অবস্থায় কেউ দেখেনি।
কেননা, যে যে দেখেছে সে-ই অজ্ঞান হয়ে গেছে। তবে মানুষদের গ্রামে তাকে নিয়ে অনেক গল্প শােনা যায়। একবার নাকি দু'জন বিদেশী লোক ঘুরতে ঘুরতে কিড়িম্বর রাজত্বে গিয়ে পড়ে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে তারা একটা উঁচু টিলার মত জায়গায় বসে জিরিয়ে নেবে ভাবল। তারা চড়তে লাগল তার উপর। খানিকটা উঠে তারা দেখল ভুমিকম্প হচ্ছে। তারা কি আর জানে যে, ওটা টিবি নয় সেটা কিড়িস্বর দেহ।
শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল সে। ভুঁড়ির উপর যে মানুষ উঠেছে সে ত আর জানে না, তার লাগছে সুড়সুড়ি। তাই সে হেসে উঠছে।
হাসির চোটে ভঁড়িতে কাপুনি ধরেছে। আর মানুষ দু'টি তাে গড়গড়ু করে গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। সেইসঙ্গে কিড়িম্বর গদাখানা পিছলে পড়ল হাত থেকে খসে। আর পড়ল সেই ঠিক সেই দুজনের ওপরে। বেচারী পথিক দুজন শুধু চিড়ে চ্যাপ্টা নয় পিষে একেবারে জেলি হয়ে গেল। এরকম অনেক গল্প লােকের মুখে শোনা যায়।
এ রকম ভয়ঙ্কর দৈত্য বটে, তবে হ্যাঁ, এটাও শােনা যায় যে, কিড়িস্ব কখনও মানুষের এলাকায় এসে হামলা করেনি। এমন কি, তাকে এদিকে আসতেই দেখা যায়নি। এতে অনেকেরই খুব আশ্চর্য লাগে। তারা বুঝতে পারে না, কেন যে দৈত্য নদী পেরিয়ে এপারে আসে না। ঐ তাে ছােট্ট নদী, তাও গরমকালে চড়া পড়ে থাকে।
ওটা পার হয়ে এলেই তাে গ্রাম।
মাঝে মাঝে লােকেরা ভুলে যায় যে, তারা অত বড় একটা ভয়ঙ্কর জীবের হাতের নাগালের মধ্যে বাস করছে। বড়েরা ভয় দেখায় বাচ্চাদের কিড়িম্বর নাম করে। বুড়ি দিদিমা ঠাকুমারা ছড়া কাটে। একটি ছড়া যেমন বসাে খােকা খেয়ে নাও
দুধটুকু খেয়ে যাও বেশি নয় শুধু এক রত্তি। কথা যদি না শােনাে
আসবে সে কে জানাে
ওরে বাবা সেই বড় দত্যি। আবার ঘুম পাড়াবার ছড়াও বলত এইরকম - রাত নিশুতি খুকু ঘুমায়
পিদিম নিভে আগে তারার বাতির মানিক নিয়ে পাড়ার লােক জুড়াবে আসিবে নারে কিড়িম্ব দূর হয়ে যা চলে আর যদি না ঘুমােও বাছা ঐ দত্যি নেবে কোলে। ছােটবড় সবাই ভয় পায় কিড়িম্বকে। কেউই ঐ ছােট নদী পেরিয়ে কোনও কিন্তু ঐ নদী পেরিয়েছিল একটি ছেলে। তাকে নিয়ে এক গল্প আছে।
রাত্রি বসে জাগে। লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমাবে
দিন ওপারে যাবার চেষ্টা করেনি। সবাই জানে নদী পেরিয়ে একটা বড় মাঠ আর মাঠের পরেই কি ডিসেম্বর রাজ্য।
সেই
গল্পই বলবাে এবার। রামুকে দেখলে মনে হবে তার বয়স পনেরাে। কিন্তু আসলে সে বারাে বছরের বেশি নয়। কালাে কালাে চেহারা। খুব ছুটতে পারে। আর লম্বা দৌড় দিয়েও সে
হাঁপায় না। রামুর আছে বাবা মা আর ছােট একটি বোন।
একপাল ভেড়া ছাগল আর গরু নিয়ে মাঠে চড়ায় সে। ভোর সকালে ও দের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে ছুটে এসে দুটি ভাত খেয়ে যায়, আর ফেরে বিকেলে ভেড়া-ছাগলের পাল নিয়ে। সন্ধ্যাবেলা প্রদীপের আলােয় বই পড়তে বসে।
প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ তার সারা। বাংলা বেশ গড় গড় করে পড়ে। ছােট ছােট অনেক
পদ্য তার মুখস্থ। দুপুরের রােদ যখন চড়া হয় তখন রামু বসে একটা মােটা গাছের ছায়ায়। চোখ রাখে ভেড়া আর ছাগলগুলির দিকে। ওরা ভীষণ ছিটকে যায় এদিক-ওদিক। কখন যে নজরের বাইরে চলে যায় কিছুই বলা যায় না। যখন দেখে মাঠের উপর
ওরা চরছে ঠিকমত তখন চেঁচিয়ে মুখস্থ পদ্য বলতে থাকে। বাতাসের শন্ পাতা নড়ার শব্দ হয় তখন। রামুর খুব মিষ্টি লাগে ঐ সময়টি। সে হয়তাে চেঁচিয়ে আওড়াতে থাকে
হীরামন তােতা রে
বাসা তাের কোথা রে?
আয়ি পাখি ছুটিয়া ধান খাবি খুঁটিয়া
খেয়ে-দেয়ে এ বাড়ি
দূর দেশে দে পাড়ি কিন্তু বেশিক্ষণ কি বসতে পারে এ ভাবে? একটা বাচ্চা ভেড়াকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। এর নাম দুধ! দুধের মত সাদা ধবধবে রং। মােলায়েম নরম লােমে তার গা
ঢাকা। আর কী মিষ্টি যে তার মুখটা। কিন্তু দুধিটা আবার তেমনি ভীষণ ছটফটে।
একদিন বাড়ি ফিরে সবকটাকে গুণতে গিয়ে রামু দেখে একটা কম। ছিল মােট চৌত্রিশটা, আছে তেত্রিশটা।
কে গেল, কে গেল, দেখতে গিয়ে দেখে সেই দুধি নেই। রামু কেঁদে ফেলল।
কি হয়েছে রে, কাদছিস কেন? মা জিজ্ঞেস করল।
দুধিকে পাচ্ছি না। কাল ঐ নদীর ধারে চরতে চরতে কখন যে সে ছিটকে
পালিয়েছে একটুও টের পাইনি। কি আর হবে কেঁদে! হয়ত নেকড়ের হাতে পড়েছে, মা বললো না গাে, রামু
বললে, নেকড়ে তে আসেনি।
তাহলে নদী পেরিয়ে যায়নি তাে? হারে, নদীতে জল ছিল? না, কোথাও কোথাও একটু জল! চড়ার ওপর দিয়ে দিব্যি পার হওয়া যায়, বললে রামু। তাহলে নিশ্চয় ওপারে চলে গেছে।
কি হবে মা?
যা হবার হয়েছে। এবার একটু হুশিয়ার থাকবি। আমি দুধিকে খুঁজে বার করবাে। আমি ওপারে যাব
খবরদার! ওদিকে যাস্ না, দৈত্যের রাজ্য, ওখানে কোনও মানুষ যায় না।
রামুর মনটা ভেঙে পড়েছে। সে মনে মনে ঠিক করল দুধিকে খুঁজে বার
করতেই হবে। কিন্তু যদি সে দৈত্যের পাড়ায় গিয়ে থাকে? যেতেও পারে। তাহলে?
, যাবে সে, বেশ তাে সে দেখে আসবে দৈত্যদের দেশটা কেমন। পরদিন রামু আর ভেড়া ছাগল নিয়ে গেল না। সে একা বেরুল। মাঠ পেরিয়ে চলল হনহন করে এসে পড়ল নদীর কাছে। নদীর চড়ার ওপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হল। চারিদিকে শ্যাওড়া-শেকুল বনের ঝােপ-ঝাড়। জন-মনিয্যি নেই। রামুর বুকটা ঢি ঢি করে উঠল, তখনই তার মনে হল দুধির কথা। আবার সে চলল হনহন
করে। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে সে। মাঠ আর মাঠ। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াচ্ছে সে। এখানে সেখানে ছােট বড় অনেক পাথরের চাই পড়ে আছে। মনে হয়, কে যেন খেলার জন্য ছড়িয়ে রেখেছে ঐসব।
অনেকদূর গেছে। একটা পাথরের উঁচু টিলার উপরে উঠে সে দেখতে লাগল - চারিদিক। হঠাৎ তার নজরে পড়ল দূরে যেন একপাল ভেড়া চড়ছে। রামুর মনটা আশায় নেচে উঠল। সে ভাবল, ঐখানে হয়তাে পেতে পারে দুধিকে। সে ছুটল সেই
দিকে।
কাছে গিয়ে দেখে এক বুড়ি। ময়লা কাপড়ে তার গা-মাথা ঢাকা। হাতে একটা লম্বা লাঠি। বুড়ির সামনে দিয়ে চলছে একপাল ভেড়া-ছাগল। রামু দেখতে লাগল একটা একটা করে। কালো সাদা বাদামী আবার টিপটিপ। ছােপওয়ালা নানান রকমের
ভেড়া।
দেখতে দেখতে এক সময় সে লাফিয়ে ওঠে, ঐ তাে, ঐ তাে, ঐ তাে, আমার
দুধ! সে ধরতে গেল দুধে।
খবরদার! হাত দিবি না এদের গায়ে, হেঁকে উঠল বুড়িটা।
এটা তাে আমার, রামু বলে ওঠে। একে আমি ঠিক চিনেছি।
সাদা দুধ লােম আর কপালে কালো চাদের টিপ। এটা আমার জিনিস। আমাকে ফিরিয়ে দাও। বাহ,
তােকে দেব কেন? কর্কশ বলায় বুড়ি বললে।
, ওটা আমার। কাল দল ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। আমি তাই ওকে নিতে
এসেছি, দাও না আমায় বুড়ি মা, রামু মিনতি করে বলে।
বুড়ির মন একটু নরম হল। সে বললে, তাের সাহস তাে কম নয়! তুই এখানে এসেছি। তা বাপু, আমি তাে দিতে পারি না। এ আমার মনিবের জিনিস। যদি নিতে চা, তাহলে তার কাছ থেকে চেয়ে
নিতে হবে।
কে তােমার মনিব? রামু জিজ্ঞেস করে।
দৈত্য রে, হিড়িম্ব দৈত্য। শুনিসনি তার নাম?
দৈত্য! সে তাে আমাকে খেয়ে ফেলবে। ভয় পেয়ে গেল রামু। হি হি করে হেসে ওঠে বুড়িটা। কই আমাকে কো খায়নি? বললে বুড়ি।
তােকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিতে পারি।
তা
দাও না, বুড়ি মা, কি শিখিয়ে দেবে, কাতর হয়ে বলে রামু। বুড়ি তখন ওর কাধে হাত দিয়ে বলে, তুই পারবি কি? তাবড় তাবড় কত লােকই তাে ওর কাছে এসেছিল। ওকে দেখেই তারা ভিরমি যায়। সেই যে পড়ে
আর ওঠে না। আর জ্ঞান ফেরে না।
ভয়ে। কেন গাে? ভয় না করলে কিছু বলবে না তাে?
, বুড়ি রামুকে অভয় দেয়। তবে সত্যি কথা বলি শােন।
সাহস দেখালে সেই দৈত্য বরং খুশি হয়। তখন আর কিছু করে না সে। এ কথা কেউ জানে না কিন্তু,
বুঝলি? ভরসা পেয়ে রামু খুশি হল। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে সেতার বুকটা ফুলিয়ে নিয়েছে। মনে মনেও ভয় করলে চলবে না। বুড়ির কথাগুলাে সে মনে মনে জপ করতে
লাগল। পুরনাে মস্ত বড় একটা দালান ঘরের মধ্যে রামুকে ঢুকিয়ে দিয়ে বুড়ি অন্যদিকে চলে গেল। ঘরে ঢুকে রামু দেখেছে দেয়ালে বড় বড় কয়েকটা ফোকর।
ওমা, ছাদটা কোথায়? এত অনেক উঁচুতে। একদিকে দেয়াল বেয়ে অশ্বথ গাছের চারা বেরিয়েছে। কি রকম একটা ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে এল।
হঠাৎ বাতাস কাপিয়ে একটা বজ্রগম্ভীর আওয়াজ এলাে, কে! কে-রে? কে তুই এখানে?
রামু তেমনি চিৎকার করে উত্তর দিল, আমি, আমি রামু। আবার গর্জন হল, কি চাই তাের? চিৎকার করে রামু বলল, আমার ভেড়া, তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। হাঃ হাঃ হাঃ। সাহস আছে দেখছি পােকার মত ছেলেটার! আমাকে দেখতে
পাচ্ছি?
রামু আবছা অন্ধকারের মধ্যে ভালাে করে তাকাল। দেখল তার সামনে - অনেকটা দূরে দুটো মােটা মােটা পা। ওপরে তাকিয়ে দেখে প্রায় ছাদে ঠেকে আছে একটা মাথা—দুটো চোখ জুলজুল করছে। ওরে বাবা! শিউর উঠল রামু।
এতাে বড় আবার মানুষ হয়।
রামুর মনে পড়ে বুড়ির কথাগুলি। ভয় পেলে চলবে না। সাহস চাই, সে প্রাণপণে চিৎকার করে বলল, আমি.তাে-মা-য় ভ-য় ক-রি-ন।। আশ্চর্য! এতটুকু ছেলে আমাকে ভয় করে না! বলে কি! কিড়িম্ব অবাক হয়। সে মাথাটা নিচু করে বললে, এই দেখ, ভালাে করে চেয়ে দেখ। আমাকে দেখতে
পেয়েছি।
রামু চেঁচিয়ে বললে, দেখেছি।
এইবার ভয় পাচ্ছে না? গর্জন করে ওঠে দৈত্য। না তােমাকে আমি ভয় করি না।
বাসরে। এ আবার কি মানুষের পাে? ভাবছে কিড়িম্ব। এমন তাে দেখেনি। যাই হােক, একটু কথা বলে দেখা যাক। তারপর আরও ভয় দেখাবাে।
দৈত্য এবার দেওয়ালের ফোকর থেকে একটা পাথর সরিয়ে নিল। তখন ঘরে অনেকটা আলাে এলাে। আর সেই আলােতে কিড়িম্বকে আরাে ভয়ঙ্কর দেখতে
হলাে।
তুই আমার রাজ্যে এসেছিস কেন?
ঐ তাে বললুম দুধিকে নিতে। চেঁচিয়ে বলল রামু। দু-ধি! সে আবার কে?
আমার ভেড়া। তােমার ভেড়ার দল আছে? ভেড়া!হা-হা-হা—অট্টহাসিতে দৈত্য যেন ফেটে পড়ছে। রামুর মনে হলাে,
যেন ঘরের মধ্যে ক্রমাগত বাজ পড়ছিল। দুটো কান সে দু'হাতে চাপল। সে চিৎকার করে বলল, অত জোড়ে হাসছ কেন?
এবার কিড়িম্বর অবাক হবার পালা। এরকম মানুষ তাে সে দেখেনি কোনও
দিন। যাই হােক, সে ভাবল, আরও একবার ভয় দেখাবার চেষ্টা করতে হবে। সে একটা হাত দিয়ে রামুর কোমরটা সাপটে ধরে শূন্যে তুলে নিল। এইবার ফেলে দিই?.... হুম, তাতেও জ্ঞান হারাচ্ছিস না!
তারপর রামুকে বসাল তার কাধে। রামুর ভয় হচ্ছিল, যদি পড়ে যায়। কিন্তু
তার নাকে একটা দুর্গন্ধ লাগল। সে বলে ফেলল, তােনার গায়ে বিচ্ছাির গন্ধ! তুমি বুঝি চান করাে না?
। দৈত্যরা কি চান করে? আমিও করি না, কেবল বৃষ্টির সময় ভিজে গা
ধুয়ে ফেলি, কিড়িম্ব বলল। তুমি দাঁত মাজ না?
, আমরা ওসব জানি না, বলল কিড়িম্ব।
এ-মা, দাঁতে পােকা হবে যে। আচ্ছা, তােমার কি কেউ নেই? —বলেই দৈত্যের কি যেন হল, সে রামুকে নামিয়ে দিল মাটিতে। নিজেও
বসল। তারপর মাথা নিচু করে রামুর দিকে তাকিয়ে রইল।
রামু অবাক হয়ে ভাবছে
দৈত্যের একি কান্ড! সে কি তাকে খেয়ে ফেলবে? দৈত্য গলাটা অনেক নরম করে বলল, দেখ রামু, আমি কখনাে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলিনি, বুঝতে পারছে।
কার সঙ্গেই বা বলবাে? আমাকে দেখেই তাে তারা অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর আর
জ্ঞান হয় না। তােমাকেই শুধু পেলুম, হ্যা, সাহসী একজন।
তুমি লােককে ভয় দেখাও কেন? রামু জিজ্ঞেস করে? , আমায় দেখেই তারা ভয় পায়, আমি কি করবাে?
তােমরা মানুষকে মেরে খাও কেন? তাই তাে লােক ভয় পায়। দেখ রামু, তােমায় এবার সত্যি কথা বলছি, কিড়িম্ব বলতে থাকে, শােনাে, আমায় কেউ চেনে না। আমি মােটেই হিংস্র নই—সেইটেই তো হচ্ছে আমার স্বভাবের দোষ।
আমার বাবা ছিল অতি ভয়ঙ্কর, যেমন দৈত্যরা হয়ে থাকে। এই বাড়ির চারদিকে দেখবে কত কঙ্কাল ছড়িয়ে পড়ে আছে। কত লােক এসে প্রাণ দিয়েছে। কত রাজা এসেছে, সৈন্য সামন্ত এসেছে যুদ্ধ করতে। বাবার সঙ্গে কেউ পারেনি।
হেরে গিয়ে সবাই মরেছে। তুমি যুদ্ধ করতে পারাে? রামু জিজ্ঞেস করে।
হায় হায়, তা যদি পারতুম।
আমার গদা আছে কিন্তু সেটি তুলে কাউকে
মারতে পারিনা। এইটিই আমার দুঃখ-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাে কিড়িম্ব।
রামু অবাক হয়ে শুনছে। সে বলল, কেন তুমি তাে ভালই আছোঁ। হিংস্র হওয়া ভালাে নাকি? মারধাের করা মােটেই ভাল নয়।
তা, নয়, আমিও ভালােভাবে জানি, কিড়িম্বি বললে, কিন্তু আমাদের যত
আত্মীয় আছে, বন্ধু আছে, তারা আমাকে বােকা বলে। তারা আমাকে ঘেন্না করে।
অনেকে বদনাম দেয়। সেইটিই আমার অসহ্য।
তােমার আপনার লােক সব কোথায় আছে? অনেক দূরে, সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ আছে। সেখানে এক চোখে দৈত্যরা
থাকে, কাছাকাছি অন্য দ্বীপে তারা ছড়িয়ে আছে। শােন রামু, আমার একটা উপকার করবে? তােমার ভেড়া তুমি পাবে। আরও অনেক কিছু পাবে। বলাে কি করতে হবে আমায়, প্রশ্ন করে রামু। এসাে আমার সঙ্গে।
দৈত্য তাকে আর একটা ঘরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, তুমি বােধ হয় শুনেছাে, দৈত্য আর রাক্ষসেরা অনেক রকম জাদু জানতাে।
ইচ্ছামত তারা ছােট হতে পারতাে, বড় হতে পারে। নানা রকম রূপ ধরতে পারতাে। মারীচ যেমন সোনার হরিণ সেজে ছিল। এসব নিশ্চই পড়েছ। কেউ কি জানে কি করে তারা করতাে এসব? তাদের জানা ছিল অনেকরকম জাদু-ওষুধ।
কোনটা খেলে মাছির
মতাে হওয়া যায়। কোনটা খেলে হাল্কা হয়ে ভেসে বেড়ানাে যায়। তােমাদের এরকম ঔষধ আছে নাকি? বলল রামু। হ্যা তাই তাে তােমাকে
দেখাব। বাবা এইসব তৈরী করত। ঐ দেখ বড় বড় জানলায় সাজানাে রয়েছে। ঐগুলাে থেকে আমাকে ওষুধ বেছে দিতে হবে। এ কাজটি তােমাকে করতে হবে।
তাহলে তােমায় এক ঘড়া মােহর দেবাে।
তােমার ভেড়াও পাবে। রামু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেন তুমি নিজেই তাে খেতে নিতে পারাে।
আমায় দিতে হবে কেন?
আহা, আমি বুঝব কেমন করে? ঐ জানালার গায়ে লেখা আছে কোনটা কি
ওষুধ। লেখাপড়া না জেনেই আমার এই বিপদ হয়েছে। আমি যে পড়তে পারি না।
ও, এই কথা! বললে রামু, তা তুমি কি হতে চাও?
আমি? আমি হিংস্র হতে চাই। ভয়ঙ্কর হতে চাই। দয়ামায়া থাকবে না। মারবাে কাটবাে কড়মড় করে চিবিয়ে খাবাে।
যাকে পাবাে তাকে আঁচড়ে মারবা দাও
দেখি, ঠিক ঐ জাদু-ওষুধের জালাটা বেছে।
রামু এগিয়ে গেল। সত্যি সে দেখল বড় বড় নানা গড়নের জালার গায়ে এক একটা লেবেল লাগানাে। তাতে লেখা আছে নানারকম ওষুধের নাম।
সে দেখল একটায় লেখা আছে, অতি হিংস্র পাচন', একটায় 'সূক্ষ্মতি জারক', আর একটায় লঘু জারক রস'। এমনি আর কত। সর্প হবার, বৃক্ষ হবার, মাছি হবার, নারী হবার কত রকম ওষুধের জালা। রামু ভাবলাে দৈত্য যা চাইছে সেটা হচ্ছে অতি হিংস্র পাচন। এটা পড়তে
তার এক মিনিটও সময় লাগল না।
কিন্তু সেটা দিতে যাবে এমন সময় হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। সর্বনাশ ! ও যদি হিংস্র হয়ে ওঠে তাহলে আমারই তাে বিপদ। সবা আগে আমাকেই তাে ও খেয়ে ফেলবে। বুদ্ধিমান রামু চটপট উত্তর দিল,
কি ভাবছাে কি? দৈত্য জিজ্ঞেস ভাবছিলাম, তুমি খাবে কি করে?
করে।
এর জন্য ভাবনা কি? তুমি দেখিয়ে দাও কোন জালোটা তাহলেই হবে? রামু তখন একটা জ্বালা ধরে টান দিল, তার গায়ে লেখা আছে লঘু বায়ু রস’ মনে
মনে সে ভাবছে, বেশ মজা হবে।
কিড়িম্ব এক মুহূর্ত দেরি না করে জালাটা ধরে শূন্যে তুলে ঢক্ক্ করে খেয়ে ফেলল সবটা। রামু ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ কাটল। তারপর ঐ বিরাট শরীর
কয়েক বার ঝাকুনি দিয়ে উঠল।
তারপর সে সােজা উঠতে লাগল মাটি ছেড়ে ওপর দিকে। যেমন গ্যাস-তরা
বেলুন ওড়ে তেমনি।
চিৎকার করে সে বলে উঠল, আমি যে হাল্কা হয়ে যাচ্ছি। ছাদে লাগতেই ছাদ গেল হুড়মুড় করে ভেঙে ঝর-ঝরিয়ে পড়ল ইট কাঠ
পাথর। শূন্যে উঠতে উঠতে কিড়িম্ব বলছে, একি করলে রামু, তুমি আমায় ভুল ওষুধ খেয়েছি ভুল ওষুধ
বেশিক্ষণ লাগল না, এল এক দমকা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ফানুষের মত দৈত্য ভাসতে লাগল শূন্যে। ভেসে ভেসে কোন দিকে কোথায় উড়ে গেল রামুর আর নজর পড়ল না।
রামু তার ভেড়াটিকে বগলদাবা করে আর মােহরের ঘড়াটি মাথায় করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। যখন বাড়ি পৌছল তখন সন্ধ্যা হয়। রামুকে দেখে মা আর বােনের কি আনন্দ। রামু বলল, মাদুর পেতে সবাই বসাে, আগে
দুধ কে খেতে দিই। তারপর সারা রাত্রি ধরে বলতে লাগল তার সারা দিনের কাহিনী।
মা বলল, দেখলি তাে বাবা, লেখাপড়া জানার কতাে দাম। তুই পড়তে পারলি বলেই না মাথায় বুদ্ধি এসে গেল। ছােট বােন বলল, আর সাহসটা বুঝি কিছু না? দাদা যদি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে
যেত, তাহলে ? দাদা তুই কি করে ঐ প্রকাণ্ড দৈত্যের সঙ্গে কথা বললি রে? তাের ভয় করল না?
মা বলল, ঠিক বলেছিস মিনু। রামুর সাহস দেখেই তাে দৈত্য তার মনের কথা বলল। কি আর কাউকে তো সে বলেনি! রামু পরের দিন সকালে উঠে দেখে আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। মেঘ
গুলি দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে ভেসে যাচ্ছে।
হঠাৎ একটা গৰ্গমে আওয়াজ কানে এল তার। কে যেন মেঘের ভেতর
থেকে কথা বলছে রামু-উ-উ, তুমি ভালই করেছে। এই দেখে আমি কেমন ভেসে ভেসে যাচ্ছি। এখন কতাে দেশ-বিদেশ, নদ-নদী, সমুদ্র-পর্বত, বন-উপবন, নগর-শহর দেখতে
দেখতে যাবাে। কথা গুলাে মিলিয়ে গেল।
এর পর কত সময় রামু যখন আকাশে মেঘ দেখে, নানা চেহারার মেঘ, কোনােটা হাতির মত, কোনােটা মন্দির, কোনোটা যেন সিংহ, আবার কোনটা বা বিরাট দৈত্যর মত। দৈত্যের চেহারা মেঘের মধ্যে দেখলেই রামুর মনে পড়ে যায়
কিরিস দৈত্যের কথা। সে যেন কেবল শূন্যে ভেসে যাচ্ছে।
ঠাকুরমার ঝুলি
No comments:
Post a Comment