রামধনুকের রাজপুত্র
স্বপনবুড়াে
নারীর রূপের কথা নিয়ে দেশ বিদেশে কেনাকাটা চলে। রূপের গৌরবে রাজকন্যার মাটিতে পা পড়ে না। রূপ নয় তো যেন আগুনের ফুলকি। তাব ওপর হীরে, মণি, মুক্তো, পান্না, চুনি দিয়ে সারাটা দেহ যেন দীপান্বিতার দেওয়ালী
উৎসব। রাজা ভাবেনএ রূপ যাবে কার ঘরে। রাণী কাদেনকোন তেপান্তরের রাজপুত্রে হাতে এ রূপের ডালি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন।
সখির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সখির মনের মানুষ মিলল কি? দলে দলে রাজপুত্র ছুটে আসে রূপের কথা শুনে, যেমন নাকি পতঙ্গের দল
দুটো আসে দীপের আলাের আভাস পেয়ে। মালঞ্চের দেশের রাজপুত্র, গজমতির দেশের রাজকুমার, জ্যেৎস্নার দেশের যুবরাজ,হাসলে চুনি কাদলে পান্নার দেশের রাজকুমার—কারা আসতে বাকি রইল না।
কিন্তু রাজকুমারীর রূপের আভায় চোখ তাদের ঝলসে গেল। রুমালে চোখ ঢেকে তারা ঘরে ফিরলে। মুখ আর কাকা পক্ষী কেউ দেখতে পেলে না। রাজার রাজকার্য বন্ধ হল।
মন্ত্রীর পাকা দাড়িতে এর কোনাে মন্ত্রী জুটলাে না। রাণী বৃথাই সকাল সন্ধ্যে শিবের মন্দিরে মাথা খুঁড়তে লাগলেন।
সখিরা বললে
সাতটা রঙের পাখনা ওড়া রামধনুকের রাজকুমার, গজমােতির মালা যাহার হবে কি গাে বর তােমার? রূপকুমারী বললে
পায়ে যার রামধনু ভালে যার সূর্য, সেই নেবে মালা মায়ের বাজাইয়া তুর্য।
কথাটা রাজা শুনলেন, রাণী শুনলেন, রাজ্যের মন্ত্রী শুনলেন আর শুনলেন সেনাপতি। রাজা শুধালেন সেনাপতি, রামধনুর দেশ কোথায়? সেনাপতি মাথা নুইয়ে বললেন, গজোমতির দেশের পাশ দিয়ে মালঞ্চের দেশের দক্ষিণ দিয়ে জ্যোৎস্নাপুরী পেরিয়ে শ্বেত দ্বীপের চামেলীর দেশের কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রামধনুর দেশের আকাশ-ছোঁয়া পুরী—আদেশ করুন এক্ষুণি সে দেশ জয় করে রাজকুমারকে সসম্মানে চতুর্দোলায় নিয়ে আসি।
বুড়াে মন্ত্রী দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, এ বল প্রকাশের কথা নয় সেনাপতি, তুমি দূত পাঠিয়ে দাও রামধনু পুরের রাজকুমারের কাছে। আমাদের রাজকন্যার রূপের কথা তাকে জানিয়ে আসুক।
রাজা বললেন, তাই ভাল সেনাপতি। কিন্তু দূত নয় আমার সভাকবি মধুশেখর
তার কবিতায় রাজকুমারীর রূপের কথা কয়ে আসুক রামধনুপুরের যুবরাজকে। এ কাজের ভার আর কারাে হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি নে। রাজাকে নমস্কার করে সভাকবি মধুশেখর রামধনুপুরের পথে গা চালিয়ে দিলে। পথের সাথী রইল শুধু তার একতারাটি।
কবিতার একতারা বাজিয়ে রাজকুমারীর রূপের গান গায়—এক মনে পথ চলে। দিন যায় রাত আসে আবার রাতের শেষে সকালের সােনালী রােদ
কবিকে অচিন দেশের পথের ঠিকানা বলে দেয়।
একুশ দিন একুশ রাত্রির পর কবি যখন গিয়ে রামধনুপুরের সাতরঙা আকাশ ছোঁয়া পুরীর ফটকের সামনে দাঁড়ালেন পূর্ণিমা চাদ তখন সবে দেবমন্দিরের পেছন থেকে উকি মেরে রামধনুপুরের সাতরাঙা জলে জ্যোৎস্নার জাল ফেলেছিল। কবি তার একতারাটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গান ধরলেন
সাতসাগরের নীলিমা শাড়ি গড়িয়াছে আঁকি বিধি, ঠোট দুটি বাঁকা গড়িয়াছে তাহা কোন্ অপরূপ নিধি!
কুস্তি তার সাপের খেলা
দন্তে শুধুই মুকুতার মেলা
অপরূপ সাজে সাজাইতে তার যুগল চরণে কি দি!
গানের সুরে সুরে দীঘির সাতরঙা জল ফুলে ফেঁপে চাদের জ্যোৎস্নার সঙ্গে
মিতালী পাতালে হঠাৎ আকাশ-ছোঁয়া রামধনুপুরীর সাতমহলের সেরা জানালাটা খুলে কে শুধুলে, ওগো দরদী কবি, তােমার গানে আমার সাত বছরের ঘুম ভেঙেছে। বল
তােমার কি চাই? কবি বললেন চাইনা আমি কিছুই, এ গান যার জন্য রচা তার কানে পৌছলে আমি ধন্য হব।
জানলা থেকে জবাব এলাে—কবি, তােমার গানে আমি ফুলকুমারীর রূপের আভাষ পেয়ে ধন্য হলুম। কিন্তু এই পুরী থেকে বেরুবার উপায় তাে আমার নেই। একটি পাখির ভিতর আমার প্রাণ লুকোনাে। সেই পাখি আজ সাত বছর নিরুদ্দেশ। সেই পাখির অতাবে আমি সাত বছর মরার মত নির্জীব হয়ে পড়েছিলুম। তুমি এসে তােমার সুরের যাদুতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলে। কিন্তু সেই সােনালী চোখওয়ালা সাতরঙা পাখি ফিরে না এলে তাে আমি আমার দেহে হারােনাে শক্তি ফিরে পাবাে
না।
কবি বললে, ওগাে রামধনুকের রাজপুত্তুর, তােমায় দেখে তােমার কথা শুনে আমি ধন্য হয়েছি। আমি ফিরে চললুম সেই রূপকুমারীর দেশে তােমার হারানাে সাতরঙা পাখির সন্ধান খুঁজে বের করতে। রাজপুত্র বললে, ওগাে বন্ধু, ওগাে কবি, এইখান থেকেই তােমায় আমার
অন্তরের প্রতি জানাচ্ছি। যদি কোনদিন সেই সাতরঙা পাখির সন্ধান মেলে তাে
আবার তােমার সঙ্গে দেখা হবে। নইলে এই শেষ। কবি তার ভাঙা একতারাটি নিয়ে রূপকুমারীর দেশে ফিরে সব কথা রাজাকে জানালে। রাজা শুনলেন। রাণী শুনলেন।
সখীদের কানে সেই কথা গেল।
রূপকুমারী রাজাকে বললেন, বাবা, পাখি আমার চাই-ই চাই। লােক ছুটলাে দেশ-বিদেশে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি। আবার ফিরে এল সব লােক। উঁচু মাথা নীচু করে সবাই বললে, মহারাজ,
পাখি তাে পেলাম না।
রাজকুমারী বলল, আবার ছুটে গিয়ে পাখি ধর। আমার মনে হচ্ছে পাখি তার রূপ বদলায়।
রাজকুমারীর আদেশে আবার সব লােক ছুটে গেল পাখি ধরতে। নানা রঙের
পাখি ধরে এনে রাজপুরী ভর্তি করে ফেলল।
রূপকুমারীর সখী ললিতা চোখের জল ফেলে বলল, রাজকন্যা এভাবে আর কতদিন পাখি ধরা চলবে? মুক্তো আকাশে যারা পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়, মনের আনন্দে গান গায়, তাদের এমনি করে শেকলের বাঁধনে বেঁধে কি তুমি তােমার
প্রাণের মানুষকে খুঁজে পাবে? রূপকুমারীর চোখ ঝলসানাে রূপে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিল। চোখ রাঙা করে সে বললে, কে আছিস তােরা ললিতাকে এক্ষুণি পাখিদের ঘরে আটক করে
রেখে দে।
ললিতা বললে, রূপকুমারী, আমায় বন্দী কর ক্ষতি নেই কিন্তু এই হুকুম দিয়ে তার সঙ্গে তােমার প্রাণের দেবতাকেও বন্দী করে রাখলে। প্রহরীর হুমকিতে ললিতার শেষ কথা রূপকুমারীর কানে পৌছল না। আঁধারে
কারাগারে ললিতার দিন কাটে, বাইরের আলাে তার কাছে যেতে পথ খুঁজে পায় না।
দিন যায়, রাত আসে আবার আকাশে আলো ফোটে। কিন্তু ললিতার কাছে সবই রাতের অন্ধকারের মতাে মিশমিশে কালাে দিয়ে ঘেরা। একদিন ঘুমের ঘােরে ললিতা শুনতে পেলে কে যেন তাকে মিষ্টি কথায়
ডাকছে।
সে চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখলে রামধনুকের সাত রঙে রাঙা চমৎকার
একরত্তি এক পাখি পিটপিটে ছােট্ট দুটো সোনালী চোখ—সোনার শিকলে বাঁধা। পাখি বললে, ওগাে ভাল মেয়ে, আমার বাঁধনটা খুলে দাও, নইলে আমি আর বাঁচবাে না।কি নিষ্ঠুর তােমরা, বলত এমন করে বেঁধে রেখে কিলাভ তােমাদের?
ললিতা বললে, আহাহা সত্যিই তাক তােমাকে এমন করে বাঁধলে? কি
মিষ্টি তােমার গলা পাখি বলল, ছেড়ে দাও আমায়। এক্ষুণি চলে যাবাে আমি অমৃতের ঝরনার
পাশে, মিঠে মিঠে ফল খাবাে। ললিতা তাড়াতাড়ি উঠে পাখির পায়ের শিকল খুলে
দিল।
ঠিক এমনি সময় খবর পেয়ে রূপকুমারী ঘরে ঢুকে বললে, কৈ সেই রামধনু
দেশের সাতরঙা পাখি?
রূপকুমারীর গলার সাড়া পেয়ে পাখি জানালা দিয়ে ফুরুত করে উড়ে গেল। ললিতা ভয়ে চোখ বুজে রূপকুমারীর পায়ের তলায় বসে পড়ল। রূপকুমারী বললে, যেখান থেকে পার আমার পাখি ধরে এনে দাও। তােমার
প্রাণ তার জামিন রইল। ললিতা বললে, পাখি বলেছিল সে যাবে ফল খেতে অমৃতের ঝরনার পাশে। রূপকুমারীর আদেশে রথ তৈরী হল।
সেনাপতি আর ললিতাকে নিয়ে তিনি রথে উঠলেন।
একমাস একদিন পরে ঝরনার সন্ধান মিললাে, কিন্তু সাত দিন ক্রমাগত চেষ্টা করেও পাখির দেখা পাওয়া গেল না।
রূপকুমারী আদেশ দিলেন, আজকে পাখি না পাওয়া গেলে পাড়াড়ের চূড়াে থেকে ললিতাকে জলে ছুঁড়ে ফেলা হবে।
সমস্ত দিন কাটল, পাখি মিলল না।
সাঁঝের মুখে সেনাপতির আদেশে একজন সৈন্য গিয়ে ললিতাকে ঝরনার জলে ফেলে দিলে। কিন্তু কোথা থেকে রামধনু রঙা পাখিটা এসে একেবারে মানুষের
মূর্তি ধরে মাঝ পথে ললিতাকে লুফে নিলে। বললে, ললিতা তােমার দয়ায় আমি খুশী হয়েছি। রামধনু পাখি আমার ছল তােমাদের রূপকুমারীকে পরীক্ষা করার জন্যই ওটা গড়েছিলাম। পরীক্ষার ওর ভাগে পড়েছে এটা—বলে রামধনুকের রাজপুত্র তার গলার গজমােতি মালা খুলে ললিতার গলায় পরিয়ে দিলে।
No comments:
Post a Comment